কোরআনে কারিমের সূরা নূরের ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যারা ওই মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তো তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্যে খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক।
নিরপরাধ ও বিবাহিত নারীর ওপর অপবাদ দেওয়ার শাস্তি সম্পর্কে আগের আয়াতগুলোতে ব্যাখ্যা দেওয়ার পর এ আয়াতটি নাজিল হয়েছে। এ আয়াতে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একজন স্ত্রী সম্পর্কিত একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
ইতিহাসে এসেছে, বনু মুসতালিক যুদ্ধের সময় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আয়েশাকে (রা.) সঙ্গে নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে যখন কাফেলা মদিনায় ফিরে আসছিল তখন হজরত আয়েশা ব্যক্তিগত কাজে কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে পেছনে পড়েন। এ সময় পেছনে পড়ে থাকা রাসূলের এক সাহাবি হজরত আয়েশাকে সঙ্গে নিয়ে কাফেলায় পৌঁছে দেন। এরপর কিছু ব্যক্তি হজরত আয়েশা (রা.) এবং ওই সাহাবিকে নিয়ে অনৈতিক কথা প্রচার করে এবং তা গুজব আকারে মানুষের মধ্যে প্রচার হয়ে যায়। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে এ আয়াত নাজিল হয়। ওই অপবাদের জন্য মানসিকভাবে ভেঙে পড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবিদের সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় এর মধ্যে ইতিবাচক শিক্ষা রয়েছে। যেসব মুনাফিক এ মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে এ ঘটনায় তারা চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকে কৃতকর্মের শাস্তি পাবে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
১. শত্রু সব সময় বাইরে থেকে হামলা করে না, মুনাফেকরা কখনও কখনও ভেতরে বসেই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ইসলামি সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
২. একটি জনগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে অপরাধ করলেও তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি পাবে। যার অপরাধ সবচেয়ে বেশি তাকে স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি শাস্তি পেতে হবে।
যা পরের আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে। সেখানে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যখন এ কথা (অর্থাৎ অপবাদ) শুনলে, তখন ঈমানদার পুরুষ ও নারীরা কেন নিজেদের লোক সম্পর্কে উত্তম ধারণা করোনি এবং বলোনি যে, এটা তো নির্জলা মিথ্যা অপবাদ?’ –সূরা নূর: ১২
‘তারা কেন এ ব্যাপারে চার জন সাক্ষী উপস্থিত করেনি; অতঃপর যখন তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, তখন তারাই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী। ’ –সূরা নূর: ১৩
‘যদি ইহকাল ও পরকালে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত, তবে তোমরা যা চর্চা করছিলে (অর্থাৎ যে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলে), সে জন্য তোমাদেরকে গুরুতর আজাব দেওয়া হতো। ’ –সূরা নূর: ১৪
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীর প্রতি মিথ্যা অপবাদকে যেসব মুমিন সাহাবি যাচাই-বাছাই না করে বিশ্বাস করেছিলেন এবং অন্যদের জন্য বর্ণনা করেছিলেন- এ আয়াতে তাদের উদ্দেশে আল্লাহ বলছেন, ‘তোমরা যখন মুনাফেকদের অপবাদ শুনলে, তখন কেন নিজেদের মুমিন ব্যক্তি সম্পর্কে উত্তম ধারণা করলে না এবং বললে না যে, এটা তো স্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ? তোমরা তো হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীর পবিত্রতা সম্পর্কে জানতে এবং চিহ্নিত মুনাফেকদের দুশ্চরিত্রও তোমাদের অজানা ছিল না। তারপরও কেন তোমরা তাদের কথা বিশ্বাস করলে? কেন তাদের কাছে এ ব্যাপারে চার জন সাক্ষী আনতে বলোনি? যদি সাক্ষী আনতে বলতে তাহলে তারা তা আনতে পারতো না; ফলে তাদেরকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি দেওয়া যেত।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, তাদেরকে যেমন পরস্পরের প্রতি সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা থেকে দূরে থাকতে হবে তেমনি কোনো অপবাদ শুনলেই তা বিশ্বাস করা যাবে না; বরং সচ্চরিত্র ও মুমিন ব্যক্তিদের পক্ষ নিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সুস্পষ্ট প্রমাণ বা আল্লাহর নির্দেশিত সাক্ষী দ্বারা ওই অপবাদ প্রমাণিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তা বিশ্বাস করা যাবে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
১. সমাজে যখন গুজব প্রচার হয়, তখন তার বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। গুজবের ব্যাপারে চুপ থাকা বা তা প্রচার করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
২. ইসলামি সমাজের প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির উচিত অপর মুমিনের ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করা।
৩. বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্মান রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ওয়াজিব বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। নবী পরিবারকে যারা অসম্মান করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬
এমএইউ/