বিশ্ব ইজতেমার উদ্দেশ্যে হলো, বিশ্বময় দাওয়াতে তাবলিগের কাজ চালু করা। ইজতেমায় আগত প্রত্যেকের অন্তরে সংকল্প করতে হবে যে, আমি মৃত্যু পর্যন্ত দাওয়াতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখব।
প্রত্যেক নবীই মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার পূর্বে প্রত্যেক রাসূলের নিকট এই মর্মে প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। সুতরাং তোমরা আমার ইবাদত করো। ’
নবীরা কালেমার জিকিরের চেয়ে কালেমার দাওয়াত দিতেন বেশি। কালেমার জিকিরের সময় অন্তরে অন্যকিছুর চিন্তা-ভাবনা আসা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু দাওয়াতের বেলায় গায়রুল্লাহ তথা অন্যকিছুর চিন্তা মনে উদয় হয় না। এ জন্য দাওয়াতের কাজ করতে বেশি বেশি।
যুগের পরিবতর্নে দাওয়াতের কাজে কোনো পরিবর্তন সাধিত হবে না। যেমন, মিসওয়াক করা প্রিয় নবীজির সুন্নত। যুগের পরিবর্তনে তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অতএব, নবীজি এবং সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে দাওয়াত দিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই আমাদেরকে দাওয়াত দিতে হবে।
সাহাবায়ে কেরাম দাওয়াতের কাজ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বিশ্বময়। তাদের দাওয়াতের উসিলায় পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলাম তরবারির জোরে নয় বরং দাওয়াত এবং সাহাবাদের উন্নত চরিত্রের বদৌলতে প্রসার লাভ করেছে। সাহাবাদের দাওয়াত ছিল একক পদ্ধতির। সেটা হলো, মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে দাওয়াত প্রদান করা।
সাহাবারা নিজেদের জান-মাল ও সময় ব্যয় করেদা ওয়াতের কাজ করেছেন। যে কাজে জান-মাল খরচ হয় সে কাজের সঙ্গে ভালোবাসা তৈরি হয়। দাওয়াতের সঙ্গে ছিল সাহাবাদের অসম্ভব ভালোবাসা। তারা ছিলেন দ্বীনের সাহায্যকারী। ফলে আল্লাহতায়ালাও তাদের জন্য সাহায্যের দরজা উম্মুক্ত রেখেছেন।
দ্বীনদার হওয়া আর দ্বীনের সাহায্যকারী হওয়া এক নয়। দ্বীনের সাহায্যের ওপর আল্লাহর সাহায্যের ওয়াদা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো, তাহলে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন। ’ আল্লাহকে সাহায্য করার অর্থ তার দ্বীনের সাহায্য করা।
আল্লাহতায়ালা মানুষকে কষ্ট স্বীকার করার ক্ষমতা দিয়েছেন। আর দ্বীনের জন্য কষ্ট স্বীকার ও সহযোগিতার ফলে ইস্তিকামাত তথা দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার গুণ সৃষ্টি হয়। যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় বিষয়।
সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন ইস্তিকামাতের মূর্তপ্রতীক। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা (রা.) বন্দি হয়ে রোম সম্রাটের নিকট উপনীত হলে সম্রাট তাকে প্রস্তাব দিলো, তুমি ইসলাম ত্যাগ করলে আমার অর্ধরাজত্ব তোমায় লিখে দেব। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা (রা.) সম্রাটের এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। সম্রাট তাকে লোমহর্ষক নির্যাতনের ভয় দেখালেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা দ্বীনের ওপর অটল, অবিচল। চোখের সামনে কড়াইয়ে তৈল গরম করা হলো। ফুটন্ত তেলে খানিকবাদেই কৈ ভাজা হতে যাওয়া আবদুল্লাহর চোখে মুখে হতাশার লেশমাত্র নেই। সম্রাট ডাকলেন। পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে গেলেন আবদুল্লাহ। সম্রাটের বক্তব্য, দ্বীন ত্যাগ করলে মুক্তি, না হয় এখনই নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন। আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা অশ্রুসজল নয়নে আশা প্রকাশ করেন, ‘হায়! আমার যদি একশ’ প্রাণ থাকতো তাহলে প্রতিটি প্রাণ আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিতাম। ’ ভরকে গেলো সম্রাট কী বলে এ মুসলমান! এরা কোনো ভিনজগতের প্রাণি নয় তো? হজরত আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফাসহ ধৃত সব সাহাবাকে তাড়াতাড়ি বিদায় দিয়ে সম্রাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এভাবেই আল্লাহর সাহায্য ধরা দিয়েছে সাহাবাদের জীবনে।
আল্লাহর গায়েবি সহায়তা ইনফেরাদি দাওয়াতের ওপর নির্ভর। আমরা গায়েবি সাহায্য বলতে বুঝি, বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ব্যতিরেখে প্রয়োজন পূরণ হয়ে যাওয়া। বিষয়টি আসলে তা নয়। বস্তুত: গায়েবি সাহায্য হচ্ছে, অমুসলিমদের দ্বীনের দাওয়াত এমনভাবে দেওয়া যাতে সে মুসলমান হতে বাধ্য হয়। নবীজি (সা.) কোনো এক সফরে ছিলেন। সাহাবারাও ছিলেন সঙ্গে। পথে জনৈক গ্রাম্য লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হলো। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে আল্লাহর দিকে দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। সে ব্যক্তি বলল, আপনি যে আল্লাহর রাসূল তার সাক্ষি কি? নবীজি (সা.) সাহাবাদের সাক্ষি করেননি। বরং একটি গাছকে ডাকলেন। গাছটি মাটি ফেঁড়ে এসে নবীজির সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে প্রস্তান করল। তা দেখে ওই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে। নবীদের জীবনে এভাবে গায়েবি সাহায্য এসেছে।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে লোক মারফত পত্র প্রেরণ করেছেন। বুঝা গেল, দাওয়াতের জন্য ব্যক্তির গমন জরুরি। পারস্যের দাম্ভিক সম্রাট কর্তৃক নবীজির পত্র ছিঁড়ে ফেলার সংবাদ মদিনায় পৌঁছলে নবীজি বললেন, সে আমার পত্র নয় বরং তার সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। পরবর্তীতে তাই হয়েছে। পারস্য সম্রাটের দ্রুত পতন হয়েছে এবং তার সাম্রাজ্য ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এটাও আল্লাহর গায়েবি সাহায্য।
সুতরাং গায়েবি সাহায্য পেতে হলে নবীজি (সা.) এবং সাহাবাদের তরিকায় দাওয়াতের কাজ করতে হবে। বিদায় হজের ভাষণে প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার একটি কথা হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও। ’ সাহাবারা সেই ময়দান থেকেই দাওয়াতের কাজে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
আমাদেরকেও টঙ্গীর ময়দান থেকে দাওয়াতের মিশন নিয়ে বের হতে হবে। ছড়িতে পড়তে হবে সমগ্র পৃথিবীতে। কারণ, এ কাজের জন্যেই তো আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বারণ করবে আর আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান রাখবে। ’
আলোচ্য আয়াতে দাওয়াতের কথা আগে এবং ঈমানের কথা পরে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, দাওয়াত এই উম্মতের দায়িত্ব এবং এর দ্বারাই ঈমান পূর্ণতা লাভ করে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৭
এমএইউ/