আরবি ড্রাইভার আবদুল জলিল আল কুশারি আদি আরবিতে রাস্তার পাশের বিভিন্ন স্থান ও জায়গার বিবরণ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উঁচু পাহাড়কে সঙ্গি করে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতগাড়িটি এগিয়ে চলছে বললে ভুল হবে।
গাড়ি থেকে বাইরে তাকিয়ে আরও অবাক। দেখি আমরা গাড়ি নিয়ে অনেক ওপরে, নিচের রাস্তাগুলো দেখা যাচ্ছে আঁকাবাঁকা সরু নালার মতো। আর গাড়িগুলো যেন বাচ্চাদের খেলনার গাড়ি।
শরীর হিম করা এমন পাহাড়ি পথে অ্যাডভেঞ্চারময় এ যাত্রাটি ছিল পবিত্র মক্কা থেকে ঐতিহাসিক তায়েফের উদ্দেশে।
মক্কা নগরীর মিনা-মুজদালিফা ও আরাফাত প্রান্তর পার হওয়ার পরই শুরু হয় তায়েফের রাস্তা। রাস্তাগুলো পাহাড়ের পাড় ঘেঁষে তৈরি। সে জন্য রাস্তার বামপাশে পাহাড় আর ডানপাশে গভীর খাদ। আল্লাহ না করুন, একটু এদিক-সেদিক হলেই গাড়ি সোজা কয়েক হাজার ফুট নিচে। পাহাড়ের সেই পাদদেশে তাকালে ভয়ও লাগে, আর না তাকালে মনে হয় কী যেন দেখা বাদ রয়ে যাচ্ছে!
তায়েফের পথে পাহাড় ঘেঁষা শুধু সড়ক পথ নয়, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় যেতে উড়াল সেতু আছে। আর রাস্তাও দুটি। একটি যাওয়ার, অন্যটি আসার। পাহাড় ঘেঁষে প্যাঁচানো বলে এ রাস্তার নাম- রিং রোড।
তায়েফে যাওয়ার পথে চোখে পড়ল পাহাড়ের কোলে তৈরি করা চমৎকার সব রিসোর্ট, পার্ক আর অবকাশ যাপনকেন্দ্র। হজের মৌসুম বলে মানুষজন খুব একটা নেই। রয়েছে ক্যাবল কারও। ড্রাইভার জানালেন, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে স্থানীয়রা এ ক্যাবল কার ব্যবহার করেন। পর্যটকরাও মনের খোরাক জোগাতে ক্যাবলকারে চড়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।
তায়েফের প্রবেশপথে ওকাজ নামক স্থানে রয়েছে ফলমূলের বিশাল বিশাল দোকান, বাচ্চাদের খেলার মাঠ। এখানে ভাড়ায় মরুভূমির জাহাজ উটে সওয়ার করা যায়।
তায়েফে যাওয়ার পথে মরুভূমিতে উট-দুম্বার পালও দেখা গেলো। দেখা মিলল, পাহাড় থেকে নেমে রাস্তার পাশে সাড়িবদ্ধভাবে দাঁড়ানো বানরেরও।
ইতিহাসের পাতায় তায়েফ নানা কারণে আলোচিত। এই তায়েফের বনি সাকিফ গোত্রে নবী করিম (সা.) দুধমাতা হজরত হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। আবার নবুওয়ত প্রাপ্তির পর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে তায়েফ এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণের পরিবতে নবীকে অত্যাচার ও নিগ্রহ করেছে। ইসলাম প্রচার করতে এসে হজরত রাসূলুল্লাহ তায়েফে প্রায় ১০ দিন অবস্থান করেছিলেন। তারপর ফিরে গেছেন তায়েফবাসীর নানা নির্যাতন সহ্য করে।
মক্কা থেকে তায়েফ নগরের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ হাজার ফুট। পুরো শহরটিই গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ওপর। মক্কা থেকে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা সময় লাগে তায়েফ আসতে।
তায়েফকে বলা হয়, ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি। চমৎকার সাজানো-গোছানো শহর। শহড়জুড়ে রয়েছে নানা ভাস্কয।
বাদশা ফয়সাল ও বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানী হিসেবে গণ্য করা হতো। বাদশা খালেদের আমলে এখানে ইসলামি শীষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
রবিশস্য ও নানান ফল-ফলাদির জন্য তায়েফ বিখ্যাত। তায়েফে উৎপন্ন আঙ্গুর, কমলা, আনার ইত্যাদি অতি দামী ফলফলাদি মিষ্টি ও পুষ্টিতে ভরপুর। বিশেষ করে তায়েফের আঙ্গুর বিখ্যাত। এছাড়া তায়েফে উৎপাদিত সবজি সৌদি আরবের চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ পূরণ করে।
প্রাচীনকাল থেকে মক্কা ও তায়েফবাসীর মাঝে ব্যবসায়িক সম্পক ছিল। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্বাস (রা.)-এর সঙ্গে তায়েফের ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। পরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান। তায়েফের প্রধান মসজিদকে ইবনে আব্বাস মসজিদ বলা হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কবর মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে। এ কবরস্থানে আরও অনেক সাহাবির কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি লাইব্রেরি আছে। সেটা অবশ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে সেখানে প্রাচীন অনেক কিতাবের সংগ্রহ আছে।
সৌদি সরকার তাদের বিশাল দেশে আকাশ যোগাযোগের পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগে ধারণাতীত উন্নতি লাভ করেছে। ফলে তায়েফের সঙ্গে পবিত্র মক্কা ও রিয়াদসহ একাধিক দিক দিয়ে উন্নত সড়ক যোগাযোগরয়েছে।
পাহাড়ের ওপর একটি শহর। অথচ দেখে বুঝবার উপায় নেই, মনে হবে সমতলে গড়ে উঠেছে শহরটি। দুই সপ্তাহধরে মক্কার লু হাওয়া সওয়া শরীরে চমৎকার স্নিগ্ধ বাতাসের ঝাপটা মনে করিয়ে দেয় প্রিয় মাতৃভূমির সবুজ-শ্যামল রূপ আর ঝিরঝির বাতাসের কথা। আকাশ কতোটা নীল হতে পারে, কিংবা আকাশের আসল রূপ কোনটা- তা আমার জানা নেই। খুব বেশি দেশ ভ্রমণেরও অভিজ্ঞতা নেই, তার পরও আমার মনে হলো- সত্যিকারের নীল দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে। যে নয়নহারা দৃশ্য বারবার দেখলেও আবার দেখার সাধ জাগবে!
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭
এমএইউ/এসএইচ