সপ্তদশ ও অষ্টাদশ খ্রিস্টাব্দ ছিল এ শহরের উন্নতি-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির স্বর্ণকাল। ওসমানি খেলাফত আমলে এটি রণকৌশলগত প্রধান নগরী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিলো।
প্রখ্যাত তুর্কি পর্যটক উলিয়া জেলবি (১৬১১-১৬৮২খৃঃ) ১৬৫৭ খৃষ্টাব্দে বুগজা সারাই ভ্রমণ করে এসে লেখেন, “শহরটি বিচিত্র পুষ্পরাজিতে শোভিত ও দারুণ সৌরভে আমোদিত। সবুজ-শ্যামল ও অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ এর অন্যতম আকর্ষণ। এর মাটি খুবই উর্বর ও চাষাবাদ সহায়ক। সিরিয়ার ছোট ছোট টিলাসমৃদ্ধ মালভূমি ছাড়া পৃথিবীতে হয়তো এর আর কোনো দৃষ্টান্ত নেই...! এটি একটি অনিন্দ্য সৌন্দর্য-মাধুর্যে ভরপুর দারুণ উন্নত, আকর্ষণীয় ও সমৃদ্ধ অঞ্চল। ”
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বুগজা সারাইতে দ্বিতল বিশিষ্ট দুই হাজারের বেশি ঘর-বাড়ি ছিলো। অনেকগুলো সৌখিন প্রাসাদ ও অট্টালিকা ছিলো। সুরম্য গম্বুজ ও মিনার বিশিষ্ট বত্রিশটি মসজিদ ছিলো। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মসজিদটি হলো, সম্রাট ছাহিব কারাই জামে মসজিদ। মসজিদে কুবা ও মসজিদে সাইপার গাজি, উরতা জুমুআ, ও তাখতালি জামে মসজিদেরও বেশ যশ-খ্যাতি ছিল। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, বর্তমানে সেখানে কেবল চারটি মসজিদ অবশিষ্ট রয়েছে। অন্য মসজিদগুলো হারিয়ে গেছে ইতিহাসের চড়াই-উতরাই ও কালের ঘূর্ণিপাকে।
আর বহু রাজা-বাদশাহ, আমির-উমারা ও আলেমদের কবর এবং কবরসংলগ্ন বিশাল বিশাল গম্বুজ বিশিষ্ট অনেক মসজিদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শহরজুড়ে। মুসলমানদের শাসনামলে শহরটিতে খৃস্টানদেরও বসবাস ছিলো। তাদের দুটি গির্জাও ছিলো। একটি আর্মেনীয়দের অন্যটি গ্রীকদের।
তাছাড়া কফির বিমল সৌরভে আমোদিত থাকতো প্রায় বিশটি কফি হাউজ। বিভিন্ন পর্যটক ও মুসাফিরদের জন্যে সাতটির মতো সরাইখানা ছিল সদাউন্মুক্ত। সর্বসাধারণের জন্যে চারটি সুইমিংপুল, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পথচারীদের জন্যে পানির ট্যাঙ্কের ব্যবস্থা ছাড়াও শহরে পাথর ও কাঠের তৈরি ৪৩টি ব্রিজ ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়ে হলো, ঐতিহ্যবাহী এসব নিদর্শন এখন আর নেই। এখন তা স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি।
ক্রিমিয়ায় মুসলমানদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি (পর্ব-১)
এমন সমৃদ্ধির পাশাপাশি বুগজা সারাই শহরকে ঘিরে ছিল, ঘন গাছপালাপূর্ণ ৩৬টি ফলবাগান ও পুষ্পকানন। নাশপাতি, আপেল, চেরিফল, খোবানি, আঙুর, পিচ-কুল, পাইন গাছ ও হরেক রকম ফল-ফলাদি এবং রংবেরঙের ফুলে ফুলে সুশোভিত ছিল সেগুলো। স্নিগ্ধ সৌরভ ছড়াতো আশপাশে। এসব বাগানে পানির সেচ দেওয়া হতো ফোয়ারা ও জলপ্রপাত থেকে। বিস্তৃত ক্ষেত-খামারগুলোতে গবাদি পশু ও ঘোড়ার পাল অবাধে বিচরণ করতো। শহরের আশপাশে সত্তরটির মতো পানির ফোয়ারা-চৌবাচ্চা ছিলো।
বুগজা সারাই শহরটি ছিল, স্বর্ণ-রৌপ্য ও পিতল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আসবাব-পত্র, অস্ত্র নির্মাণশিল্প ও খনিজ জাতীয় পদার্থের বিশাল বিক্রয়কেন্দ্র। হস্তশিল্পেরও বেশ কদর ছিল সেখানে। চামড়ার তৈরি বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর বিপুল সমাহারও ছিল।
কোরআন হাদিস, শরিয়তি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আরবি ভাষা শিক্ষার নিমিত্তে সেখানে কয়েকটি মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছিল। তুর্কি পর্যটক উলিয়া জেলবির বর্ণনা মতে ১৭টি মাদ্রাসা ছিল। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল জেনজিরলি নামের মাদ্রাসাটি। এটিকে পূর্ব ইউরোপে সবচেয়ে প্রাচীন মাদ্রাসা বা যেকোনো ধরনের প্রাচীন শিক্ষানিকেতন হিসেবে গণ্য করা হতো। সম্রাট মিনক্লি কারাই প্রথম ১৫০০ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এতে বিশাল শ্রেণিকক্ষ, ছাত্রাবাস, সুইমিংপুল ও মসজিদ ছিল।
বুগজা সারাই শহর থেকেই ইউক্রেন, রাশিয়া, পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও আক্রমণমূলক সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হত। সেসব যুদ্ধে ক্রিমিয়ায় অবস্থিত ওসমানি খেলাফতের দুর্গগুলো থেকে বিভিন্ন স্থল ও জলযুদ্ধে ব্যাপক সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল।
১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে রুশ পরাশক্তি ক্রিমিয়ায় আগ্রাসন চালায়। রুশবাহিনী জনগণের অঢেল ধন-সম্পদ ও বিত্তবৈভব লুণ্ঠন করার পর পুরো শহর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়া পুরোপুরি তাদের দখলে নিয়ে নেয়। এর আগে রাশিয়া ইতিহাসের কোন অধ্যায়ই ক্রিমিয়া দখল কিংবা শাসন করতে পারেনি। তবে খুব স্বল্পসংখ্যক রাশিয়ান নাগরিক ক্রিমিয়ায় বসবাস করতেন।
১৭৭৮ খৃস্টাব্দে রাশিয়ান সম্রাট দ্বিতীয় ক্যাথেরিন বুগজা সারাইয়ে সামরিক হামলা চালিয়ে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার কর্তৃত্ব নিশ্চিত করে ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ক্যাথরিন কিছুদিন ক্রিমিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রাসাদে অবস্থানও করেন।
১৮৫৪ সালে তদানীন্তন ওসমানি খেলাফত ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। আলমা নদীর তীরে যুদ্ধও সংঘটিত হয়। কিন্তু ওসমানিরা তাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।
শত নির্যাতন-নিপীড়ন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও অনৈতিক শোষণের পরও ক্রিমিয়ান মুসলমানরা তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি। ১৯৪৪ সালের ১৮ মে তারা মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার সাইবেরিয়ার ওরাল অঞ্চলে দেশান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অপাঙক্তেয় জনগণ হিসেবে জীবন যাপন করে আসছিলেন
ক্রিমিয়ান মুসলমানদের উৎসব ও ঐতিহ্য
প্রতি বছর ১০ মার্চ ক্রিমিয়ার দুটি মসজিদে ঘটা করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক উৎসবের দিন ক্রিমিয়ান মুসলমানদের মাঝে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়।
সেখানে ক্রিমিয়ান মুসলিম নাগরিকরা নিজেদের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রদর্শন করেন। মাটির তৈজসপত্র, প্রাচীন কালের জিনিসপত্রে আদলে তৈরি উপহার সামগ্রী ও উন্নত মানের কার্পেট থাকে প্রধান আকর্ষণ। অনুষ্ঠানে তাতার মুসলিম মেয়েরা নিজস্ব স্টাইলে নৃত্য পরিবশন করে। পাশ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের মুসলমানরাও এতে অংশ নেয়। ইউক্রেন, রাশিয়া, চেকপ্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির মুসলমানরাই বেশি আসে।
সময়ের আবর্তে কালের পরিক্রমায় ঐতিহাসিক এ মুসলিম জনপদের দিগন্ত থেকে ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধ্রুবতারা ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। এ অঞ্চলের মুসলমানদের নাজুক অবস্থা অতিক্রান্ত হচ্ছে। বলতে গেলে বর্তমান কর্ডোভা, গ্রানাডা, সেভিয়া, টলোডো ও হারানো অন্যান্য ঐতিহাসিক জনপদগুলোর মতোই। তবে ক্রিমিয়ার জনপদ থেকে ইসলাম পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। সংখ্যালঘু মুসলমানরা সরকারি শত চাপের মুখেও তাদের ঈমানি আদর্শ ও চেতনা, ইসলামি কৃষ্টি-কালচার ও স্থাপত্যশিল্প ধরে রেখেছেন। প্রতি বছর বেশ কিছু ক্রিমিয়ান মুসলমান পবিত্র হজব্রত পালন করে থাকেন। (সমাপ্ত)
ঋণ স্বীকার:
১। সাপ্তাহিক আল-মুজতামা—কুয়েত থেকে প্রকাশিত। (সংখ্যা নং ২০৮৩, জুলাই ২০১৪ ইং)।
২। ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা।
৩। আল-মুনজিদ—আরবি অভিধান ও বিশ্বভূগোল মানচিত্র।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৮
এমজেএফ