গোত্রনেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা-হঠকারিতা, কুলিনদের দাম্ভিকতা, পুঁজিবাদীদের আগ্রাসী থাবা কত মারাত্মক-ভয়ঙ্কর এবং মনাবসমাজ ও জীবনযাত্রা অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতার গহ্বরে তলিয়ে যেতে পারে তা তিনি কৈশোরেই আঁচ করেছিলেন। তাই মানব-প্রকৃতি থেকে হয়তো তিনি পণ করেছিলেন, পৃথিবীতে শান্তির আবহ ও পরিবেশ গড়ে তুলতেই হবে।
আর অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির স্নিগ্ধ-বাতাস বইয়ে দেওয়ার জন্যেই তো—মহান বিধাতা আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছুটেছেন শান্তির ফেরি করে। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় করেছেন নিরন্তর সংগ্রাম ও সাধনা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাকে গোটা বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। ’ (সুরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)
শান্তির নিমিত্ত যার জন্ম, আজীবন সে ঠিকানায় তিনি ছুটে চলবেন—এটাই স্বাভাবিক। তাই তো বোধহীন শৈশবে, দুরন্ত ও রাঙা কৈশোরে, উদীপ্ত তারুণ্যে এবং জীবনসায়াহ্নে তিনি ছুটেছেন একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে।
তারুণ বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামের শান্তিসংঘ গঠন করে তিনি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর্তের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সহযোগিতা করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা ছিল শান্তিসংঘের অঙ্গীকার বাণী। মানুষের কল্যাণে তার গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
মদিনায় হিজরতের পর তিনি সেখানে শান্তিপূর্ণ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। মদিনায় বসবাসরত মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে তিনি একটি ইসলামী সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প করেন। তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতাদের আহ্বান করে একটি বৈঠকে বসে তাদের বিশ্বমানবতার ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবশ্যকতা বুঝিয়ে একটি সনদ প্রস্তুত করেন। মদিনায় বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সবাই এ সনদ মেনে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এভাবে তিনি মদিনার জীবনে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করে শান্তি স্থাপনের বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধি ও রাসুলের শান্তি প্রতিষ্ঠা
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) এর অনবদ্য ভূমিকার অনন্য স্মারক হুদায়বিয়ার সন্ধি। কিন্তু আল্লাহর রাসুল সাহাবিদের প্রবল মনোরোষ ও বিরোধিতা সত্ত্বেও কোরাইশদের সঙ্গে এক অসম চুক্তিতে উপনীত হলেন। বাহ্যিক পরাজয়মূলক হওয়া সত্ত্বেও কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তিনি এ সন্ধিতে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির ছয়টি ধারার প্রতিটি ছিল চরম মানবতাবিরোধী ও বৈষম্যমূলক। চরম অপমানজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ। চুক্তির ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে সামান্য বোধের মানুষের মনেও প্রশ্নের উদয় হওয়ার কথা, হযরত মুহাম্মদ (সা.) কেন এমন চুক্তি স্বাক্ষর করলেন? তিনি তা করেছিলেন শুধুই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। বস্তুত অল্প সময়ের মধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছিল।
মক্কা বিজয়ের দিন বিশ্বশান্তির বার্তা
শান্তিপূর্ণভাবে চূড়ান্ত মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্র কাবার চৌকাঠে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন তার সামনে অতীতের সব জঘন্য অপরাধ নিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিল মক্কার অধিবাসীরা। তাদের ঘিরে নির্দেশের অপেক্ষায় তীক্ষ্ণ তরবারি হাতে মুসলিম সেনাদল দাঁড়িয়েছিল।
মক্কার অপরাধীদের সে সঙ্গীন মুহূর্তে মহানবী (সা.) চাইলে বলতে পারতেন, ‘যে হাত শান্তিকামী তাওহিদবাদীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল, ওই হাতগুলো কেটে দাও! যে চোখগুলো অসহায় মুসলমানদের দিকে হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে তাকাত, সে চোখগুলো উপড়ে ফেলো! যে মুখ আল্লাহ, তার রাসুল ও মুমিনদের বিরুদ্ধে শুধুই মিথ্যা অপবাদ, বিষোদগার ও কুৎসা রটনা করে বেড়াত, সে জিবগুলো কেটে ফেলে দাও!’
তিনি চাইলে আরো ঘোষণা করতে পারতেন, ‘আজ থেকে কোরাইশ জালিমদের পুরুষরা বিজয়ী মুসলিম বাহিনীর গোলাম আর নারীরা দাসী হিসেবে গণ্য হবে। ’
অত্যন্ত আশ্চর্য হলো, কোরাইশরাও তাদের প্রাপ্য এমনটা ছিল বলে বিশ্বাস করেছিল; কিন্তু মহানবী (সা.) অপার বদান্যতা ও অনুপম মহানুভবতা দেখালেন। তিনি বলেছিলেন, ‘লা-তাছরিবা আলাইকুমুল ইয়াওম, ওয়া আন্তুমুত্তুলাক্বা। ’ অর্থাৎ ‘আজ তোমাদের কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত-স্বাধীন। ’
শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে মক্কার জীবন ও মদিনার জীবন—সর্বত্রই ষড়যন্ত্র, সংঘাত, যুদ্ধ ও মুনাফেকি মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে। শত অত্যাচার-নির্যাতন ও যুদ্ধ করে আজীবন যে জাতি নবী করিম (সা.)-কে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে, সেসব জাতি ও গোত্রকে মক্কা বিজয়ের দিন অতুলনীয় ক্ষমা প্রদর্শন করে এবং তাদের সঙ্গে উদার মনোভাব দেখিয়ে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই তিনি একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বসমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ রচনা করে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৮
এমএমইউ/এসএইচ