ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ঐতিহ্যের প্রাণবন্ত নগরী ইস্তাম্বুল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০১৯
ঐতিহ্যের প্রাণবন্ত নগরী ইস্তাম্বুল ঐতিহ্যের প্রাণবন্ত নগরী ইস্তাম্বুল। ছবি: সংগৃহীত

সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ধর্মীয় কারণে ইস্তাম্বুল যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বুকে গুরুত্বপূর্ণ নগরী হিসেবে সমধিক পরিচিত হয়ে আছে। তাছাড়া দৃষ্টিনন্দন ও চিত্তাকর্ষক পর্যটনস্থল হিসেবেও তার জুড়ি মেলা ভার। তাই আজও  ইস্তাম্বুল সগর্বে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে।

ভৌগলিক অবস্থান
ইস্তাম্বুল তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মর্মরা অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত একটি প্রদেশ। উত্তরে কৃষ্ণ সাগর এবং দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরে ঘেরা এ নগরীকে বসফরাস প্রণালি দু’ভাগ করে রেখেছে।

পশ্চিম দিক এশিয়ায় অবস্থিত। আর পূর্ব দিক ইউরোপে। পশ্চিমে তাগিরদাগ প্রদেশ এবং পূর্বে স্কোরিয়া ও কোগলি প্রদেশ অবস্থিত।

এ নগরীকে দু’ভাগ করে রেখেছে বসফরাস প্রণালি।  নগরীর পশ্চিম দিক এশিয়ায় আর পূর্ব দিক ইউরোপে।

ইস্তাম্বুল নগরের পরিধি ৫ হাজার ৪৬১ বর্গ কি.মি। এরমধ্যে স্থলভাগ হলো ৫ হাজার ৩৪৩ বর্গ কি.মি। প্রশাসনিকভাবে এতে ৩৯টি পৌরসভা রয়েছে। ২৭টি মূল সিটির অন্তর্ভুক্ত। ইস্তাম্বুলের আবহাওয়া মধ্যমাত্রার। তবে গ্রীষ্মকালে উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। আর শীতে শিলাবৃষ্টি ও তুষারপাত ঘটে। শরত ও বসন্তে পরিবেশ থাকে স্বাভাবিক।

নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের পবিত্রস্থান
ইস্তাম্বুলে প্রায় এক কোটি চল্লিশ লাখ লোকের বসবাস। নানা ধর্ম ও বর্ণের লোকজনের বসবাসের জন্য তা খুবই বিখ্যাত। তদুপরি অনেক ধর্মের লোকদের কাছে এখনো পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত। তবে সেখানে মুসলিমদের সংখ্যাই খুব বেশি। আর অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে আছে আলাভিরা। তারাই সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও আছে রোমান অর্থডোক্স খ্রিস্টান, আরমেনিয় অর্থডোক্স খ্রিস্টান, ক্যাথলিক খ্রিস্টান, ল্যাটিন, সেফারদিম ইহুদি ও আশকানায ইহুদিগোষ্ঠী।

বসফরাস প্রণালির পশ্চিম দিক এশিয়ায় আর পূর্ব দিক ইউরোপে।

ইস্তাম্বুলের যত নাম
ইতিহাসে ইস্তাম্বুল নগরি বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত। বাইজান্টাইন, কুসতুনতিনিয়া, আসতানা ও ইসলাম্বুল নামসহ আরো অনেক নামেই বিখ্যাত এ নগরী পরিচিত ছিল। ইস্তাম্বুলের নগরসভ্যতা নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু হয়। প্রত্নতত্ত্বের মাধ্যমে বোঝা যায় খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে এখানে বসতি গড়ে ওঠে। বসফরাফ প্রণালি তৈরির আগেই এখানে জনবসতি হয়েছে।

ইউরোপ-এশিয়া দুই পাশেই শোভা পায় মিনারের সৌকর্য।

ইস্তাম্বুল নগরের নির্মাণ-ইতিহাস
সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ইস্তাম্বুলের ইউরোপ অংশের বাইজিদ নগর প্রথমে গ্রিকরা নির্মাণ করে। ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট প্রথম কুসতুনতিন বাইজানটাইনকে রোমের রাজধানী হিসেবে নির্ধারণ করে এবং এর নাম পরিবর্তন করে কুসতুনতিনিয়া রাখেন। এ সময় ইস্তাম্বুল রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক দিক থেকে সবার মিলনস্থলে পরিণত হয়। তাছাড়া রোমের অর্থডোক্স খ্রিস্টানদের কাছে তা ধর্মীয় স্থানে পরিণত হয়। আয়া সোফিয়া গির্জা তাদের কাছে পবিত্রতম স্থানে পরিণত হয়।

ভূমধ্য সাগরের নীল ঢেউ আর মসজিদের উপস্থিতি সৃষ্টি করে অন্য রকম আবহ।

হাদিসে ইস্তাম্বুলের কথা
সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের বিজয় শুরু হলে কুসতুনতুনিয়ার প্রতি মুসলিমদের ছিল আগ্রহ। রাসুল (সা.)-এর সুসংবাদ লাভের আশায় সবাই তা বিজয় করতে মরিয়া ছিল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই কুসতুনতিনিয়া বিজয় হবে। সেই সেনাপতি কতই না উত্তম হবে। আর সেই বাহিনীও কতই না উত্তম বাহিনী হবে। ’ (মুসানাদে আহমদ)।

তুরস্কের মসজিদগুলো প্রায় একই নির্মাণশৈলীতে নির্মিত।

প্রিনবী (সা.)-এর সুসংবাদের ভাগী হওয়ার জন্য উমাইয়া শাসনামলে অসংখ্য বার ইস্তাম্বুল আক্রমন করা হয়। তবে প্রতিবারই মুসলিম বাহিনী ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। কারণ এ নগরীর সুরক্ষায় বাইজান্টাইনবাসী নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করত না। তাই এ নগরী অদ্ভূত নিরাপত্তার বেষ্টনিতে ঘেরা ছিল। তবে বার বার আক্রমনের ফলে এর নিরাপত্তার প্রাচীর ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে।

ইতিহাসের দিক-বদল
অর্থডোক্সদের সঙ্গে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের দ্বন্ধের সূত্র ধরে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা অর্থডোক্সদের ওপর হামলা করে বসে। প্রাচ্যে চতুর্থ বারের মতো ক্রুসেডারদের আক্রমন হলে তখনই তারা এ আক্রমন করে কুসতুনতুনিয়া দখল করে সেখানে গণহত্যা চালায়।

ঝলমলে রোদে মুগ্ধতা ছড়ায় বসফরাস প্রণালি।

উসমানি খেলাফতের অধীনে
উসমানিরা খেলাফতের শাসনভার লাভ করলে ধীরে ধীরে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য দখল করে সেখানের বড় বড় শহর-নগর শাসন করতে শুরু করে। ফলে কুসতুননিয়া প্রবেশের স্থলপথ ইরমিত ও বোর্সার মতো আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ নগর দখল হতে থাকে। এতে করে কুসতুনতিনিয়া এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

অবশেষে ১৪৫৩ সালের ২৯ মে উসমানি সাম্রাজ্যের সেনাপতি সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ আল-ফাতেহের হাতে কুসতুনতিনিয়া বিজয় হয়। খুব বিস্মকর পন্থায় সমুদ্রপথ ও জলপথের নিরাপত্তার প্রাচীর ভেদ করে দীর্ঘ ৫৩ দিন অবরোধের মাধ্যমে তা হস্তগত হয়।

সন্ধ্যায় ইস্তাম্বুলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।

কুসতুনতুনিয়া থেকে ইস্তাম্বুল
উসমানিদের এ অবিস্মরণীয় বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ উসমানি সাম্রাজ্যের রাজধানী এদ্রিন থেকে কুসতুনতুনিয়ায় স্থানান্তর করেন। অতঃপর তার নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামবুল’ বা ইসলামের নগরী রাখা হয়। আর তখন থেকেই এ নগরের ইতিহাস ভিন্ন রূপ নিতে শুরু করে।

ইস্তাম্বুল নগরীকে পূর্বের মতো সভ্যতা-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয় উসমানিরা। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা নানা সভ্যতার উন্নত নগরে পরিণত হয়।

রাতের মনোরম আলোয় বসফরাস প্রণালির এপার-ওপার।

ইসলামি খেলাফতের রাজধানী
১৪৫৩ সালে মিশরের সর্বশেষ আব্বাসি খলিফার খেলাফত থেকে অব্যাহতি নেওয়ার মাধ্যমে উসমানি সুলতান প্রথম সেলিম মুসলিম উম্মাহর খলিফা হিসবে স্বীকৃতি পান। আর এতে করে ইস্তাম্বুল নগরীও ইসলামি খেলাফতের রাজধানীতে পরিণত হয়। আর তখন থেকেই ইস্তাম্বুল উন্নতি-অগ্রগতি ও শক্তিমত্তার শীর্ষ চূড়ায় আরোহন করে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বরেণ্য ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে ইস্তাম্বুলের ভূমি।

ইস্তাম্বুল নগরী ইসলামি খেলাফতের রাজধানীও ছিল।

উসমানি সাম্রাজ্যের পতন
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর মিত্রশক্তি ইস্তাম্বুল দখল করে এবং সেখানেই পরবর্তীতে উসমানি সাম্রাজ্যের শেষযাত্রা রচিত হয়। কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে আবির্ভাব ঘটে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের। আতাতুর্ক শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলে রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে আঙ্কারায় স্থানান্তর করা হয়। তবে ৫০-এর দশকের পর থেকে আধুনিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির ফলে ইস্তাম্বুল আজও স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিককেন্দ্র
ইস্তাম্বুল তুরস্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিককেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। পুরো দেশের শতকরা ২০ ভাগ শ্রমিক সেখানে কাজ করেন। জাতীয় উৎপাদনের ২২ভাগ সেখান থেকে আমদানি হয়। রাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ ট্যাক্স আসে এ নগরী থেকে। রপ্তানিপণ্যের ৫৫ ভাগ উৎপন্ন হয় সেখানে। ইস্তাম্বুলের স্থানীয় পণ্যের শতকরা হার ২০১৪ সালে ছিল ১৭৫ মিলিয়ন ডলার। এতে বোঝা যায় দেশের মোট স্থানীয় পণ্য উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ ইস্তাম্বুলেই হয়ে থাকে।

ঐতিহ্যের ইস্তাম্বুল।  ইস্তাম্বুলের ঐতিহ্য।

ইস্তাম্বুলে সর্বাধিক উৎপাদিত উল্লেখযোগ্য পণ্য হলো তুলা, করমারি ফল-ফলাদি, সূর্যমুখী ফুল, যাইতুন ইত্যাদি। ইস্তাম্বুলে উৎপন্ন দ্রব্যাদির অধিকাংশ হলো খাদ্য, বস্ত্র, তেল, রবার, রসায়নিক ও চামড়াজাত দ্রব্য, ঔষধশিল্প, ইলক্ট্রনিক্স ও কাঁচজাত দ্রব্য।

পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য
ইস্তাম্বুলের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে পর্যটন খাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটকদের সেবায় অত্যাধুনিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (infrastructure) চালু থাকায় নগরের আয়ের বড় অংশ আসে পর্যটনখাত থেকে। ফলে প্রতি বছর পর্যটকদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। তাছাড়া ইস্তাম্বুলে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিবিষয়ক নানা রকম বড় বড় অনুষ্ঠান হয়। ২০১৪ সালের এক পরিসংখ্যান মতে পৃথিবীর ৩৫ মিলিয়নের মালিকরা সেখানে থাকে। যার ফলে ইস্তাম্বুল ধনীদের বসবাসের দিক থেকে পৃথিবীর চতুর্থতম ধনী নগর বলে গণ্য হয়।

ইতিহাসের বিখ্যাত স্থাপনাগুলো ইস্তাম্বুল নগরীকে বিশ্বের ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে প্রিয় করে রেখেছে।

ঐতিহ্য করেছে ভ্রমণপ্রিয় এ নগরী
ইতিহাসের বিখ্যাত সব স্থাপনা ইস্তাম্বুল নগরীকে বিশ্বের ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে প্রিয় করে রেখেছে। উসমানি সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক মসজিদ জামে সুলাইমান, শাইখ জাদাহ, সুলতান আহমদ, সুলতান ফাতেহ, জামে আবু আইউব মসজিদসহ আরো অন্যান্য বিখ্যাত মসজিদ রয়েছে ইস্তাম্বুলে। ঐতিহাসিক ক্যাথিড্রাল আয়াসফিয়াও সেখানে অবস্থিত। উসমানি যুগে মুসলিমরা তা মসজিদে রুপান্তর করেছিল। কামাল আতাতুর্ক এসে তা মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলে।

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সুন্দরের মোহনা এ নগরী এবং  বসফরাসের প্রণালি।

মিউজিয়াম ও শেষের কথা
ইস্তাম্বুলে অবস্থিত পানোরাম মিউজিয়াম খুবই প্রসিদ্ধ। ১৪৫৩ সালের বিজয়ের স্থিরচিত্র সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে। সেখানে আরো আছে তোপকাপি মিউজিয়াম, দোলমা বাহজ মিউজিয়াম। আর দোলমা বাহজে থেকেই শেষ ১শ বছর উসমানিরা পুরো সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছে।
 
এছাড়াও ইস্তাম্বুল ফুলের জন্য খুব বিখ্যাত। অসাধারণ ফুলের সমাহার সেখানে। বিখ্যাত গুলহানা গার্ডেন সেখানে অবস্থিত। তুর্কি বাথ সিনেমা ও ক্যাফের জন্য ইস্তাম্বুল সবার কাছে খুব প্রসিদ্ধ।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।