তৎকালীন মুসলিমদের বহুধা বিস্তৃত আবিষ্কারযজ্ঞের অন্যতম হলো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা। মুসলিম সভ্যতায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস-কথন হাজার বছরের প্রাচীন।
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলিম সকালবেলা কোনো রোগীর সেবা-শশ্রুষায় করে, ৭০ হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যাবেলা শ্রশ্রুষা করতে যায়, সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে তাকে একটি বাগান দেওয়া হয়। ’ (তিরমিজি, হাদিস: ৯৬৯)
হাসপাতালগুলো দাতব্য-ধর্মীয় সম্পদ বা ওয়াকফের অর্থায়নে পরিচালিত হতো। যদিও কিছু কিছু হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণ, সেবা-শুশ্রুষা ও সার্বিক খরচপাতিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থও ব্যবহৃত হতো। আংশিকভাবে হলেও এই তহবিলের কারণে হাসপাতাল ব্যবস্থা দ্রুত বলিষ্ঠ, শক্তিশালী ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান এবং নগর-জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছিল। (এ.হুইপল, দ্য রোল অব দ্য নেস্টোরিয়ান্স অ্যান্ড মুসলিমস ইন দ্য হিস্টোরি অব মেডিসিন, ফ্যাকসিমিলে অব দ্য অরিজিনাল বুক, প্রকাশ ১৯৭৭; এ. ইসা বে, হিসতোইরে দেজ হোপিতাক্স এন ইসলাম, দারুর রাইদ, বৈরুত, পৃষ্ঠা: ১১২-১১৫, প্রকাশ ১৯৮১)
মুসলমানদের আগে গ্রিকদের নিরাময়-শুশ্রুষার জন্য কেন্দ্র-মন্দির ছিল। এগুলো স্বাস্থ্যসেবা, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও অনুশীলনের পরিবর্তে একটি অলৌকিক নিরাময়ের ধারণার উপর ভিত্তিশীল ছিল। একটি গ্রিক বাইজানটাইন দাতব্য সংস্থা, জেনোডোচিয়ান (আক্ষরিক ভ্রমণকারীদের নিবাস বা গৃহস্থ), এমন একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উপক্রম হয়েছিল—যেখানে রোগী-কুষ্ঠরোগী, অক্ষম ও দরিদ্রদের যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। যদিও প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, চীন, পারস্য ও ভারতের প্রাথমিক হাসপাতাল ছিল বলে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মন্তব্য রয়েছে। তবে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত অপর্যাপ্ত ও প্রতুল। তবে অনস্বীকার্য যে, মানুষ তৎকালীন চিকিৎসা-সংক্রান্ত সংস্কৃতিগুলোর মাধ্যমে রোগ-নিরাময়ের জন্য নিবেদিত কেন্দ্রে কিছুটা হলেও প্রথাগত চিকিৎসা পেতেন।
হাসপাতাল তৈরির প্রেরণা-ইতিহাস
মহানবী (সা.)-এর যুগে অসুস্থদের সেবা-শুশ্রূষা করা হতো দুইভাবে। মহানবী (সা.) যুদ্ধে আহত সাহাবিদের জন্য যুদ্ধের ময়দানের অনতিদূরে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যোপযোগী স্থানে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দিতেন। তাঁবু ছিল আহত অসুস্থ সাহাবিদের অস্থায়ী হাসপাতাল।
খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলমানরা চিকিৎসাসেবার জন্য স্বতন্ত্র তাঁবু স্থাপন করে। সাদ ইবনে মুআজ (রা.) যখন যুদ্ধে আহত হন, রাসুল (সা.) তাকে এই স্বতন্ত্র তাঁবুতে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসব তাঁবুতে আহতদের সেবার জন্য নিযুক্ত থাকত নারী সাহাবি অন্যান্যরা চিকিৎসা দানে নিযুক্ত থাকতেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসের আদিতম ও প্রাচীন চিকিৎসা-ব্যবস্থা। মুসলিম উম্মাহর অন্যতম গৌরব ও ঐতিহ্যেরও অংশ এটি। আজকের পৃথিবীর ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও চিকিৎসার ধারণাটি এখান থেকেই মানুষ নিয়েছে। (এডি জাব্বার, ইউনে হিসতোরিয়ে, পৃষ্ঠা: ৩১৯)
বিভিন্ন ধরনের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় মুসলিম শাসক
ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে রয়েছে, পরবর্তী খলিফা ও শাসকদের আমলেও ভ্রাম্যমাণ এ চিকিৎসাব্যবস্থা চালু থাকে। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান (৬৪৬-৭০৫) বিপুল অর্থ ব্যয় করে একটি বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মনোযোগ দেন।
তখনকার প্রতিথযশা বিজ্ঞ চিকিৎসকদের হাসপাতালটিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। রোগীর শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী পৃথক পৃথক বিভাগ ছিল। প্রতিটি বিভাগের জন্য ছিল ওই বিষয়ের পারদর্শী চিকিৎসক। তারা সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দিত। রোগীর বাড়তি সেবার জন্য ছিল নার্স। পুরুষ ও নারীর জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। পরিবেশ ছিল সুখকর ও আনন্দদায়ক। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে ছিল ফুল-ফলের নানা রকম ও রঙের গাছগাছালি ছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানসিক হাসপাতাল
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানসিক হাসপাতাল নির্মাণ করেন খলিফা ওয়ালিদ ইবনে মালিক (৬৬৮-৭১৫)। তিনি ৭০৫ থেকে ৭১৫ সাল পর্যন্ত খলিফার পদে আসীন ছিলেন। তার পর থেকে মানসিক রোগ চিকিৎসায় বিজ্ঞানীরা উন্নতি সাধন শুরু করেন। কুষ্ঠব্যাধির জন্যও বিখ্যাত ছিল হাসপাতালটি। চিকিৎসকদের জন্য ভালো অঙ্কের বেতন-ভাতা নির্ধারিত ছিল। (ড. রাগের আস-সারজানি, কিস্সাতুল উলুম আত্তিব্বিয়্যাহ ফিল হাদারাতিল ইসলামিয়্যাহ, অনলাইন ভার্সন: ২০/০২/২০১৩)
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় খলিফা হারুনুর রশিদ
৮০৫ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ (৭৬৬-৮০৯) ইরাকের বাগদাদে সাধারণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাসপাতালের কার্যব্যবস্থা অল্প দিনের ভেতর বেশ খ্যাতি ছড়ায়। প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ৩০টির বেশি প্রায় সমমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বাগদাদের বিখ্যাত গ্রন্থাগার ‘বায়তুল হিকমাহ’ও প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ ও সংগঠিত হাসপাতাল
তবে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় ৮৭২ থেকে ৮৭৪ হিজরি সময়কালে। আর এই হাসপাতালটি ছিল মিশরের কায়রোর আহমদ ইবনে তুলুন মসজিদ। এতে বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা হতো। (সূত্র: ১০০১ উদ্ভাবন: মুসলিম সভ্যতার স্থায়ী উত্তরাধিকার, তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৫৪)
আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতালটিতে দুইটি বাথহাউস (একটি পুরুষদের জন্য ও অন্যটি নারীদের জন্য), একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞও ছিলেন। ফলে চিকিৎসাকেন্দ্রের পাশাপাশি এটি ছিল একটি উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক পাঠালয়। (এস.কে হামার্নেহ, হেলথ সায়েন্স ইন আর্লি ইসলাম, ভলিয়ম: ০২; এম.এ আনিস, নুর হেলথ ফাউন্ডেশন অ্যান্ড জাহরা পাবলিকেশন্স, প্রকাশ ১৯৮৩, পৃষ্ঠা: ১০১-১০২)
আরও অভাবনীয় বিষয় হলো, তখনকার রোগীরা তাদের গায়ের কাপড়-পরিধেয় বদলে কর্তৃপক্ষের দেওয়া বিশেষ ওয়ার্ডের জামাকাপড় পরতেন। এছাড়াও তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র ও জামাকাপড় ইত্যাদি নিরাপদের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা রাখতেন। (আল-মাকরিজি, খিতাত, ভলিয়ম ০২, পৃষ্ঠা: ৪০৫)
হাসপাতাল ব্যবস্থার অব্যাহত যাত্রা
মধ্যযুগে মুসলমানদের তৈরি সবচেয়ে উন্নত, বিস্তৃত বিন্যাসসমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব হাসপাতাল তৈরি হয় ৯৮২ সালে। হাসপাতালটি ‘মুসতাশফা আল-বাগদাদি’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এতে ২৪ জন চিকিৎসক ও ২৮২ জন চিকিৎসাকর্মী নিযুক্ত ছিলেন।
নবম শতাব্দীতে বাগদাদের হাসপাতালগুলো বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল। তখন সেখানে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানি ও ধর্মবেত্তা-পণ্ডিত আবু বকর আল-রাজি কাজ করেছিলেন। বাগদাদের প্রতিটি হাসপাতালে তখন মানসিক রোগীদের জন্য আলাদ ও স্বতন্ত্র ওয়ার্ড ছিল।
কারাগারের কয়েদিদের চিকিৎসাসেবা
দশম শতকে কারাগারের কয়েদিদের সুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্য জেলের ভেতর মিনি হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। হাসপাতালের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা প্রতিদিনই বন্দিদের পরীক্ষা করতেন। এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিতেন। (প্রাগুক্ত)
এছাড়াও দ্বাদশ শতাব্দীতে তৎকালীন সভ্যতা-সংস্কৃতির রাজধানী দামেস্কে আরও বড় একটি হাসপাতাল ছিল। এটির নাম ছিল ‘মুসতাশফা আন-নুরি’ বা নূরি হাসপাতাল। (এস.কে হামার্নেহ, হেলথ সায়েন্স ইন আর্লি ইসলাম, পৃষ্ঠা: ১০০)
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত ম্যানুয়াল অনুসারে জানা যায়, তৎকালীন হাসপাতালগুলোতে কিছু নির্ধারিত চিকিৎসাগ্রন্থের মাধ্যমে মাদকাসক্ত, হাঁড়ভাঙা, অস্থি ও চোখের চিকিৎসা ও সেলুনের পাশাপাশি পরিদর্শক-বিশেষজ্ঞরাও নিযুক্ত ছিলেন। হাসপাতালগুলোতে কেবল শারিরিক চিকিৎসা নয়, বরং অন্যান্য অসুস্থতারও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা ছিল।
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও চিকিৎসাসেবায় মুসলিম সভ্যতার এই সময়কালে ক্রমেই মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেন, সিসিলি ও উত্তর আফ্রিকার মরোক্কো হয়ে পৌঁছে যায় ইউরোপের আন্দালুসিয়ায় (স্পেনে)। (সূত্র: ১০০১ উদ্ভাবন: মুসলিম সভ্যতার স্থায়ী উত্তরাধিকার, অনলাইন ভার্সন)
আল-কারউয়িন হাসপাতালের বৈচিত্র্য
নবম শতাব্দীতে মরোক্কোর আল-কারউয়িন হাসপাতালটি একটি অত্যাধুনিক প্রতিষ্ঠান। দর্শনার্থীদের জন্য অপেক্ষা কক্ষ (ওয়াটিং রুম), রোগীদের ইবাদত ও পড়াশোনার জন্য একটি মসজিদ, নিয়মিত চিকিৎসক, সুদান থেকে আগত নারী নার্স এবং ফিকহ সংক্রান্ত সমাধানের জন্য বেশকিছু মুফতি-বিজ্ঞজনদের নিয়ে ফিকাহবোর্ড (ফুকাহাউল বদন) সুসংগঠিত ও চমৎকার ব্যবস্থা ছিল।
কুষ্ঠরোগীগের জন্য ‘দারুল জুযাম’ নামে আলাদা একটি হাসপাতাল ছিল, আল-কারউয়িন হাসপাতালের অনতিদূরে। তখন কুষ্ঠরোগকে মানুষ অসৎ আচরণের লক্ষণ বলে মনে করতো।
রক্ত সঞ্চালন ও হাঁড়ের সংশ্লেষের চিকিৎসার জন্য একশ্রেণীর বিজ্ঞ-পণ্ডিত যারা চিকিৎসক নিযুক্ত ছিলেন। চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সময় তারা রোগীদের হাসি-খুশি রাখতেন। হাসপাতাল আঙিনায় বিভিন্ন রকম আনন্দ-কৌতুকের ব্যবস্থা ছিল।
আল-কারউয়িন হাসপাতালটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের খরচে পরিচালিত হতো। এছাড়াও দেশের ধনাঢ্য ও বিত্তশালীরা হাসপাতালের জন্য উদারভাবে অর্থ দান করতেন। সর্বোত্তম যত্নের ব্যবস্থা করার জন্য তারা তাগিদ দিতেন। আর মানুষের সেবা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতেন।
কায়রোর বিখ্যাত আল-মানসুরি হাসপাতাল
দ্বাদশ শতকের শেষে ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে কায়রোতে কায়রোতে তিনটি হাসপাতাল ছিল; সর্বাধিক বিখ্যাত আল-মনসুরি হাসপাতাল। ‘নাসিরি’ হাসপাতালটিও বেশ সমৃদ্ধ ও প্রসিদ্ধ ছিল। এ সময়ে ইরানের রাইত শহরে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন জগতের অন্যতম মনীষী বিজ্ঞানী আল-রাজি। (ই.টি উথিংটন, মেডিকেল হিস্টোরি ফ্রম দ্য আর্লিস্ট টাইমস, প্রকাশ ১৯৯৪, পৃষ্ঠা: ১৬৬)
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিশরের মামলুক শাসক সুলতান আল-মনসুর কালাওয়ুন (শাসনকাল: ১২৭৯-১২৯০) যুবরাজ থাকাকালে সিরিয়ায় একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। পথিমধ্যে তিনি রেনাল কোলিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য তাকে দামেস্কের নুরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তিনি যে চিকিৎসাসেবা পেয়েছিলেন, তা এতটাই ভালো ছিল যে সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি অনুরূপ একটি হাসপাতাল-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার শপথ করেছিলেন। সেই শপথের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কায়রোর আল-মনসুরি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা শেষে তিনি বললেন, ‘আমি এখানে আমার ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো আমার সবধরনের প্রশাসনিক লোকবল, সৈনিক ও রাজপরিবারের ছোট-বড় সব সদস্য এবং স্বাধীন-দাসের সব নারী-পুরুষের জন্য উত্সর্গ করে দিলাম। ’ (এ. ইসা বে, হিসতোইরে দেজ হোপিতাক্স এন ইসলাম, পৃষ্ঠা: ১৫১)
আল-মানসুরি হাসপাতালের অবকাঠামোগত অবস্থা
১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে আল-মানসুরি হাসাপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় চারটি প্রবেশ পথ নির্মিত হয়েছিল। প্রতিটি পথেই একটি করে ঝর্ণা ছিল। সুলতান কালাওয়ুন চিকিৎসকদের সহযোগিতায় উপযুক্ত কর্মী ও অসুস্থদের যত্নের জন্য সার্বিক সুবিধাসমৃদ্ধ ও সবধরনের সরঞ্জামাদির মজুদ নিশ্চিত করেছিলেন। পৃথক ওয়ার্ডের রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নারী-পুরষ আলাদা নার্সও নিয়োগ করেছিলেন।
শয্যাগুলোতে গদি ছিল আরামদায়ক। বিশেষ জামাকাপড়েরও ব্যবস্থা ছিল। হাসপাতালের সব জায়গায় প্রবহমান পানি সরবরাহ করা হতো। পাঠদান এবং বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ভবনের এক অংশে প্রধান চিকিত্সককে একটি কক্ষ দেওয়া হয়েছিল। রোগীদের সেবা দেওয়ার কোনো সংখ্যা নির্ধারিত ছিল না। রোগীদের জন্য কোনো বিধিনিষেধও ছিল না। রোগী হাসপাতাল ছাড়তে চাইলেব বাহন ও ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল।
মুসলিম বিশ্বের হাসপাতালগুলো দক্ষতা, পারদর্শিতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে পরিচালিত হতো। দ্বাদশ শতাব্দীর পরিব্রাজক ইবনে জুবায়ের আল-নুরি তৎকালীন হাসপাতালগুলোতে রোগীদের সেবা-কল্যাণ দেওয়ার যে চিত্র দেখেছেন, তার প্রশংসা করে তিনি বলেছিলেন, নুরি হাসপাতালের দৈনিক বাজেট প্রায় ১৫ দিনার। হাসপাতালটির একজন অধ্যক্ষ রয়েছেন। রোগীদের নাম লিপিবদ্ধ করা, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, খাবারের, উপাদান, চিকিৎসা পদার্থ এবং এই জাতীয় জিনিসগুলির ব্যবস্থাপনার জন্য এসব ব্যয় নির্বাহ করা হয়। চিকিসৎকরা ভোরে অসুস্থদের পরীক্ষা করেন এবং প্রত্যেকটি রোগীকে রোগের উপযোগী ওষুধ ও খাবার দেওয়ার জন্য কর্মীদের আদেশ দেন। ’
ইবনে জুবায়ের বাগদাদের হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা দেখে এগুলোকে ‘ইসলামের গৌরবের অন্যতম নিদর্শন’ বলে আখ্যাও দেন। (ডব্লিউ. ডুরান্ট, দ্য অ্যাজ অব ফেইথ, পৃষ্ঠা: ৩৩০-৩৩১); ড. মুস্তাফা আস-সিবায়ি, রাওয়ায়িউ মিন হাদারাতিনা, দ্রষ্টব্য)
হাসপাতালের সঙ্গে মেডিকেল স্কুল
‘ইদারাতুল মুস্তাশফা’ বা হাসপাতালগুলোর মেডিকেল স্কুলে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রায় প্রতিটি হাসপাতালের সঙ্গে একটি করে মেডিকেল স্কুল ছিল। আটশ বছর আগের এই শিক্ষামূলক হাসপাতালগুলো শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক এবং তাত্ত্বিক পাঠ সরবরাহ করেছিল। (ইবনে আবি উসাইবাহ, উয়ুনুল আনবা ফি তাবাকাতিল আতিব্বা: ৩/২৫৬-২৫৭; অ্যা. মুলারের তত্ত্বাবধানে কায়রো থেকে প্রকাশিত। )
পাঠদান দুইটি গ্রুপে ‘একের ভেতর দুই’ ভিত্তিতে দেওয়া হতো। হাসপাতালের একটি বড় হলে বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হতো। বিষয়বস্তু-পঠন সাধারণত চিকিত্সকরা চিকিৎসা (তিব্ব) পান্ডুলিপি থেকে পড়তেন। পড়া শেষে প্রধান চিকিত্সক বা সার্জনকে শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত প্রশ্ন করার সুযোগ পেতেন। (এ. হুইপল, দ্য রোল..., পৃষ্ঠা: ৮১)
প্রচুর শিক্ষার্থী দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে তারা পাঠ-অধ্যয়ন করতেন। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বে প্রচুর পরিমাণে কাগজ-খাতার ছিল, তাই তারা পাঠগুলো পাণ্ডুলিপি আকারে সংরক্ষণ করে রাখতেন। তখন ইউরোপে এই ধরনের পাঠ্য বিষয় দুর্লভ ছিল। আর খুব কম ইউরোপীয় শিক্ষার্থী এ ব্যাপারে যত্ন নিতেন।
চিকিৎসকরা যখন ওয়ার্ডের রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণে যেতেন, তখন শিক্ষার্থীদের একটি দল প্রশিক্ষণের জন্য তাদের সঙ্গ দিতেন কিংবা তাদের অনুসরণ করতেন। এটাকে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য করতেন। আর সিনিয়র শিক্ষার্থীরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসকরা রোগীদের অবস্থা নিরীক্ষণ, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তাদের জন্য প্রেসক্রিপশন তৈরির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতেন। (এস.কে হামার্নেহ, হেলথ সায়েন্স ইন আর্লি ইসলাম, পৃষ্ঠা: ৯৯)
নুর উদ্দিন ইবনে জাঙির মেডিকেল স্কুল
দামেস্কের আল-নুরি হাসপাতালেও একটি মেডিকেল স্কুল ছিল । চিকিৎসক আবু আল-মাজিদ আল-বাহিলির পরামর্শে দ্বাদশ শতাব্দীর শাসক নুর উদ্দিন ইবনে জাঙি (১১১৮-১১৭৪) হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নুর উদ্দিনের নামানুসারে হাসপাতালটিকে ‘আল-নুরি হাসপাতাল’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছিল। রোগীদের প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত খাদ্য ও ওষুধ এতে সর্বদা মুজদ থাকতো। পাশাপাশি হাসপাতালে বিশেষ হলে রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে মেডিকেল বইও দান করেছিলেন তিনি। (এস.কে হামার্নেহ, হেলথ সায়েন্স ইন আর্লি ইসলাম, পৃষ্ঠা: ১০০)
মুসলমানদের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার মান দেখে ক্রুসেডাররা এর প্রশংসা করেছিল। পরে তারাও একই ধরনের হাসপাতাল-প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। (এম. মেয়েরহোফ, সায়েন্স অ্যান্ড মেডিসিন, পৃষ্ঠা: ৩৪৯-৩৫০)
ইসলাম বিভাগে আপনিও লেখা পাঠাতে পারেন। জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্ন ও লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৯
এমএমইউ