ঢাকা, শনিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঐতিহ্যবাহী মমিন মসজিদ (ভিডিও)

এইচ এম লাহেল মাহমুদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০২১
ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঐতিহ্যবাহী মমিন মসজিদ (ভিডিও) ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঐতিহ্যবাহী মমিন মসজিদ

পিরোজপুর: শতবর্ষী ও দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পুরাকির্তীর নিদর্শন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কাঠের তৈরি মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের জন্য সরকারিভাবে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মসজিদের রুগ্নরূপ। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা পরিবারসহ স্থানীয়দের মধ্যে এ নিয়ে চরম ক্ষোভ রয়েছে। মসজিদটি যাতে বৃষ্টির পানিতে নষ্ট না হয় সেজন্য এর বেড়ার নিচের অংশে পলিথিন দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এর সামনে টিনের চালা দিয়ে নামাজ আদায় করতে হচ্ছে। আর এ টিনের চালা দেওয়ার কারণে মসজিদের প্রকৃত ডিজাইন ও নির্মাণশৈলী নষ্ট হয়েছে।

মসজিদের ভেতরে দেখা গেছে, এর পাটাতনের কয়েকটি তক্তা নেই। বেড়ার বিভিন্ন অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। পানিতে নষ্ট হয়ে এর চৌকাট খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ছোট করে টিনের পাত কেটে কোনোরকম ওই সব চৌকাটে জোড়াতালি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

সৌন্দর্যের দিক থেকে বাংলাদেশের একমাত্র ও অদ্বিতীয় এ মসজিদটি সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া না হলে তা ধ্বংস হয়ে যাবে বলে স্থানীয়রা জানান।

মসজিদটি দেখতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের থাকার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। এখানে মসজিদ ও এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানার জন্য নেই কোনো জাদুঘর বা পাঠাগার।

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতার নাতি আমেরিকার থমাস জেফারসন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মো. শহিদুল্লাহ আকন জানান, মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তাদের দায়িত্বে নেওয়ার পর যে ধরনের উন্নয়নের কাজ হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। মসজিদটি রক্ষার জন্য নেই কোনো সংস্কারের উদ্যোগ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর দায়িত্ব নেওয়ায় আমরা পারিবারিকভাবে এর সংস্কারেও হাত দিতে পারছি না। মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এছাড়া এর ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে এখানে পর্যটকদের থাকার জন্য একটি বাংলো ও পাঠাগার স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে মসজিদটি দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওই মসিজদের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী মমিন উদ্দিন আকনের নাতি মাস্টার মো. আবুল কালাম আজাদ আকনের কাছে। তিনি এর অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি জানান, বর্ষার সময় মসজিদের চালার বিভিন্ন স্থান থেকে পানি পড়ে মেঝেতে ভিজে যায়। এ এলাকাটি নিচু হওয়ায় বর্ষা কালে এর মেঝ বা ফ্লোর পানিতে প্লাবিত হয়। এছাড়া পানিতে ভেজার কারণে এর কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। ২০০৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এর দৈন্যতা আরও বেড়ে গেছে। এটি দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে এটি সংস্কারের জন্য সরকারিভাবে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও সেই টাকা পুরোপুরি খরচ করা হয়নি। তখন এর সংস্কারের কাজে ব্যবহার  করা হয়েছে নিম্নমানের দেশিয় কাঠ। ফলে এর পাটাতনের কাঠ ঘুনে ধরেছে। এর মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের নেই কোনো সরকারি বেতন। এছাড়া এর বৈদ্যুতিক বিলসহ বিভিন্ন খরচ আমাদের পরিবার থেকে দিতে হচ্ছে।

মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্বে থাকা মাওলানা মো. নাইম হোসেন জানান, মসজিদের পাটাতন ঘুনে ধরেছে। এর বিভিন্ন অংশ ভেঙে যাচ্ছে। এটার দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন।

মসজিদের প্রতিষ্ঠা কাল

মরহুম মৌলভী মমিন উদ্দিন আকন এ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।    ১৯১৩ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ৭ বছর ধরে ২২ জন কাঠ মিস্ত্রি কাজ করে এ মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। এর নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছিলো শাল, সেগুন ও লোহা কাঠ। এসব মূল্যবান কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিলো মিয়ানমার, ত্রিপুরা ও আসাম থেকে। সম্পূর্ণ লোহাবিহীন এর নির্মাণ কাজ করেছেন জেলার নেছারবাদ উপজেলার দক্ষ কাঠ মিস্ত্রিরা।

এ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতার নাতি মো. আবুল কালাম আজাদ আকন জানান, মসজিদটি নির্মাণের প্রধান মিস্ত্রি ছিলেন স্বরূপকাঠীর শ্রী হরকুমার মিস্ত্রী।

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতার পরিচয়

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী মমিন উদ্দিন আকন ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা মরহুম মৌলভী ইব্রাহিম আকনের ছেলে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তার পিতা মৌলভী ইব্রাহিম আকন ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা হাজী শরিয়াতুল্লাহর পুত্র মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার ফরায়েজী আন্দোলনের গাও (গ্রাম) খলিফা। আর মমিন উদ্দিনের দাদা ইদির হাওলাদারসহ তার ২ সহোদর খিদির হাওলাদর ও ইসাব হাওলাদার ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী যোদ্ধা। তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের যোদ্ধা ঝালকাঠীর সুগন্দিয়া গ্রামের বালকি শাহর সহযোদ্ধা হিসেবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেন। ১৭৯২ সালে সেখানে যুদ্ধকালে ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে তাদের পরাজয় হয়। পরে তারা সেখান থেকে পলায়ন করে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার উদায়তার বুড়িরচর গ্রামে এসে অবস্থান নেন। সেখানে এসেও ৩ ভাই ১৮৩০ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত তুষখালীর কৃষক বিদ্রোহ ও ১৮৫৮ সালের শিংখালীর কৃষক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। আর এ বিদ্রোহের ফলে ১৮৫৯ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিটিশ সরকার পিরোজপুরে মহাকুমা স্থাপন করে।

মসজিদের অবস্থান

মসজিদটি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ধানীসাফা ইউনিয়নের উদায়তারা বুড়ির চর গ্রামে অবস্থিত। মসজিদের সামনে রয়েছে একটি বিশাল মাঠ। স্থানীয়দের উদ্যোগে পরবর্তী সময়ে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর সামনে একটি বড় পুকুর রয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

ঢাকা বা দেশের যেকোনো স্থান থেকে লঞ্চ বা বাসে করে পিরোজপুরে আসতে হবে। সেখান থেকে পিরোজপুরের চরখালী ফেরিঘাট হয়ে মঠবাড়িয়ার উদ্দেশে যেতে হবে। সেখানে থেকে যেকোনো বাহনে মঠবাড়িয়ার সাপা বাজারের পরে তুষখালী বাসস্টেশন থেকে মমিন মসজিদ সড়ক ধরে মমনি মসজিদে যেতে হবে।

এ মসজিদটি সংস্কারের ব্যাপারে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের এমপি ডাক্তার রুস্তুম আলী ফরাজী জানান, মসজিদটি সংস্কারের জন্য ও এর করুণ দশার বিষয়ে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে জানানো হয়েছে। দ্রুত এর সংস্কারের কাজে টাকা বরাদ্দ হবে।

 

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২১
এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।