ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস

ইমরুল ইউসুফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৩
অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস

১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে বাঙালির প্রাণের ভাষার মাস। এ মাসেই আমরা অজর্ন করেছিলাম প্রিয় বাংলা ভাষা।

ইচ্ছেঘুড়িতে পুরো মাস জুড়েই থাকবে ভাষা, একুশে বইমেলা নিয়ে নানা আয়োজন। বন্ধুরা, এখন থেকে নিয়মিত চোখ রাখো ইচ্ছেঘুড়ির পাতায়।

‘বইমেলা’ কিংবা ‘গ্রন্থমেলা’ শব্দ দু’টির যেকোনো একটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমী আয়োজিত একুশে বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে লাখো মানুষকে টেনে আনে একাডেমীর বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে।

বর্ধমান হাউস ও এর আশপাশ ঘিরে জমে ওঠে লেখকদের জমজমাট আড্ডা। কাটে লেখক প্রকাশকদের নির্ঘুম রাত। প্রকাশিত হয় হাজার হাজার বই। নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে মোহিত হয় মেলায় আসা ক্রেতা, দর্শনার্থী। বিক্রি হয় লাখ লাখ কপি বই।

ভিড় ঠেলে প্রয়োজনীয় বইটি হাতে পাওয়ার পর আনন্দে চিক চিক করে ওঠে মুখ। তারপর বইটি বগলদাবা করে প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়ার চেষ্টা। মঞ্চের সামনে বসে আলোচনা কিংবা দাঁড়িয়ে একটু গান শোনা। এসবই আমাদের কাছে খুব চেনা এবং জানা একটি বিষয়। কিন্তু আমরা অনেকেই এই মেলার ইতিহাস জানি না। চলো টচ করে জেনে নেই অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের কাছে ব্যাপকভাবে একুশে বইমেলা নামেই পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মেলার ইতিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মতোই প্রাচীন।

যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার শুরু করেন। এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই।

১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী মহান একুশে মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমী প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি মুক্তধারা, স্টান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং এদের দেখাদেখি আরও কেউ কেউ বাংলা একাডেমীর মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ।

ঐ গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমীর পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে বাংলা একাডেমীর কোনো ভূমিকা ছিলো না শুধু মাঠের জায়গাটুকু দেওয়া ছাড়া।

১৯৭৫ সালে একাডেমী মাঠের কিছু জায়গা চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়। প্রকাশকরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। এ সময় পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি ছিলো না। কোনো নামও দেওয়া হয়নি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও এর কোনো উল্লেখ থাকতো না।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানসূচিতেও এই কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ করা হয়নি।
 
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন।

১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ঐ সময় অমর একুশে উপলক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। মেলার তখন নাম ছিলো একুশে গ্রন্থমেলা।

১৯৮১ সালের একুশে বইমেলার মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন করা হয়। কিন্তু প্রকাশকদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে মেলার মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করে করা হয় ২১ দিন। মেলার উদ্যোক্তা বাংলা একাডেমী। সহযোগিতায় ছিলো জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।

১৯৮৩ সালে মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে এই মেলা মেলার নতুন নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।

প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাড়ানো হয় মেলার পরিসর। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির প্রাণের বইমেলায় পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে লেখক প্রকাশক পাঠকদের মহামিলন তীর্থে।

আগে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হতো। এরপর ক্রেতা, দর্শক ও বিক্রেতাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এই মেলা নিয়মিতভাবে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

মেলায় প্রায় পাঁচশ’ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সারিবদ্ধ স্টলের মধ্যে একপাশে থাকে শিশু কর্নার। আরেক পাশে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল। এই সংখ্যা অবশ্য কোনো কোনো বছর বাড়ে আবার কমে। বহেড়া তলাকে ভাগ করা হয় লিটল ম্যাগাজিন চত্বর হিসেবে। এছাড়া মেলা চত্বরকে ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নামে ভাগ করা হয়।

এবার একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণকে চারজন ভাষা শহীদ সালাম, রফিক, বরকত ও শফিউরের নামে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়া নজরুল মঞ্চের সামনে শিশু কর্নারে থাকবে শিশু কিশোর বিষয়ক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। প্রতিবারের মতো এবারেও নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে নজরুল মঞ্চে। মেলার প্রচার কার্যক্রমের জন্যে তথ্যকেন্দ্র থাকবে বর্ধমান ভবনের পশ্চিম বেদিতে।

মেলায় থাকে মিডিয়া সেন্টার। যেখান থাকে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা। এছাড়া থাকে লেখক কর্নার এবং তথ্যকেন্দ্র। মেলা প্রাঙ্গণ রাখা হয় পলিথিন, ধূমপান এবং হকারমুক্ত। মেলায় বই বিক্রির উপর ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় থাকে। এছাড়া মেলায় নিরাপত্তাবাহিনীর পাশাপাশি রাখা হয় বিশেষ টাস্কফোর্স। যারা মেলার সার্বিক নিরাপত্তার পাশাপাশি বইয়ের কপিরাইট বা মেধাসত্ত্ব আইন লঙ্ঘন করেছে কিনা সনাক্ত করেন ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেন।

মেলা চলাকালীন প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর বসে। প্রতি সন্ধ্যায় থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া মেলার লেখককুঞ্জে লেখকেরা তাঁদের বইয়ের ব্যাপারে পাঠক ও দর্শকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

মেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের খবর, প্রতিদিন প্রকাশিত বইগুলোর নাম, লেখক ও প্রকাশকের নাম প্রাকাশ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেল মেলার মিডিয়া স্পন্সর হয়ে মেলার তাৎক্ষণিক খবরাখবর দর্শক শ্রোতাদের অবহিত করে। এবারের মেলাও তার ব্যতিক্রম হবে না। সুতরাং আর দেরি নয়। সময় পেলেই চলে এসো বইমেলায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি-ichchheghuri@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।