ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

সজনে কথন | প্রিসিলা রাজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৮
সজনে কথন | প্রিসিলা রাজ সজনে ফুল

‘কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাটায়
ভরে গেছে গাছটা,

আর, আমি ডালের বড়ি
শুকিয়ে রেখেছি-
খোকা তুই কবে আসবি!
কবে ছুটি?’
 
কবিতার চরণগুলো কোন কবিতা থেকে নেওয়া তোমরা বলতে পারবে? কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বিখ্যাত কবিতা ‘মাগো, ওরা বলে’ থেকে। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত কবি তিনি।

১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের কথা তোমরা তো সবাই জানো। মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছিল এদেশের মানুষ। আর তাতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরের মতো ছাত্র-যুবকেরা। কত শত ছাত্র-যুবক কারাগারে গিয়েছিলেন। অনেক মেয়েও ছিলেন তাদের মধ্যে। কবি সেই ভাষা আন্দোলন নিয়েই লিখেছেন এই বিখ্যাত কবিতা।
 
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর এই অপরূপ কবিতাটি পড়েছিলাম অনেক আগে, যখন স্কুলে পড়ি সেই সময়। আমাদের বাংলা বইয়ে ছিল কবিতাটি। মনে আছে, অদ্ভুত ভালো লেগে গিয়েছিল কবিতার চরণগুলো। শুধু আমার না, সহপাঠীরা সবাই কবিতাটিকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আর আমাদের সবার মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা যেন হয়েছিল আরো গভীর।
 
গাছে ঝুলছে সজনেকিন্তু তারও আগে, আরো ছোটবেলায় ডাটায় ভরা বিরাট সজনে গাছ আমার দেখা হয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলায় আমরা থাকতাম অনেক বড় এক বাগানবাড়িতে। সেই বাড়ির সীমানায় ছিল এক বিরাট সজনে গাছ। মানে, গাছটা সত্যি সত্যি বিরাট ছিল, নাকি আমি ছোট ছিলাম বলে অত বড় লাগতো তা ঠিক মনে নেই। আমাদের বাসায় সজনেকে সজিনা বলা হতো। মাঘ-ফাল্গুন মাসের শীত শেষ হয়ে আসার সময়টাতে গাছটা ফুলে ফুলে ভরে যেত। সারাদিন সাদা ফুলগুলো টুপটাপ করে ঝরে পড়তো, আর গাছতলাটা সাদা হয়ে থাকতো।
 
কিছুদিনের মধ্যেই গাছে সজনে ডাটা দেখা যেতো। উপর থেকে সবুজ ডাটাগুলো ঝুলতে শুরু করতো। মনে আছে, সজনে ডাটা পেড়ে আনাটা একটা বড় সমস্যা ছিল কারণ, সজনে গাছের ডাল খুব নরম, বড় মানুষ চড়লে মড়মড় করে ভেঙে পড়তে পারে। আমাদের বাসার লম্বা ছেলেগুলো বড় বাঁশের আগায় ছুরির মতো দেখতে কাটারি বেঁধে সজনে পেড়ে আনতো।
 
ছোটবেলায় আমার সজনে ফুল দেখতে বেশি ভালো লাগতো না। এমনিতে কিন্তু আমার বুনোফুল দেখতে খুব ভালো লাগতো। নানা ধরনের সবজির ফুলও দেখে বেড়াতাম। কিন্তু সজনে ফুল কেন যেন বেশি পছন্দের ছিল না। ফুলটার প্রতি ভালোবাসা জন্মালো মাত্র বছর কয়েক আগে যখন সাভারে আমার বন্ধুর বাগানে আবার তার দেখা পেলাম।
 
সেবার সাভারে ওদের বাসায় গিয়ে দেখি সজনের ছোট একটা গাছে এক ঝুঁটি সজনে ফুল ফুটে আছে। আমার বন্ধুর মা গাছ খুব ভালোবাসেন তাই বাসার চারিদিকে নানান জাতের গাছ লাগিয়েছেন। সজনে গাছ খুব সহজেই হয়। একটা ডাল পুঁতে দিলেই চলে। তিনিও তাই বাসার চারধারে বেশ কয়েকটা ডাল লাগিয়েছিলেন। সজনে গাছ লাগালে তিন-চার বছরেই ফুল ধরে ফল চলে আসে। খালাম্মার লাগানো গাছগুলোতেও তাই হয়েছিল। তিন বছরে গাছগুলো খুব বড় হয়নি, কিন্তু ফুল ফুটেছে ঠিকই। এতো কাছে সজনে ডালে ফুলগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তার মধ্যে একটা ফুলের ছবি তুললাম বেশ কিছু। কী সুন্দর চারধারে ঝুলে থাকা কয়েকটি পাপড়ি আর মাঝে হলুদ কয়েকটি পরাগ।
 
ফুলভর্তি সজনে ডালসেই ভালো লাগাটা রয়ে গেছে আজও। এখন তো ঢাকায় প্রায় দেখাই যায় না সজনে গাছ। মাঘ-ফাল্গুন মাসে গ্রাম-গঞ্জে গেলে চোখটা অন্য গাছের মাঝখানে ফুলে ভরা সজনে ডালও খোঁজে। সজনে ফুলে ভরা ডালে মাঝে মাঝে ফিঙে পাখিও বসে। সে দৃশ্য আরো সুন্দর, আরো মনোহর।
 
আরেকটা দুঃখের কথা বলি। ছোটবেলা তো সজনে ডাটার চচ্চড়ি, সজনে ডাটার ডাল আর আরো কত রকমের রান্না খেয়েছি ইচ্ছেমতো। কিন্তু তখন জানতাম না, সজনে ফুল আর সজনে পাতাও খাওয়া যায়। সজনে ফুলের বড়া আর কচি সজনে পাতার ভর্তার মতো সুস্বাদু খাদ্য নাকি কমই হয়। বড় হয়ে যখন জেনেছি তখন তো আর আশপাশে সজনে গাছ নেই। তাই সাভারে বন্ধুর বাড়ির গাছই ভরসা। সেখানে গেলে পাতার ভর্তা যেমন খাই তেমনি শীতের শেষে ফুলের বড়াও খাই। তোমরা যারা এর স্বাদ নাওনি তারা এখনই সজনে গাছের খোঁজে বেরিয়ে পড়ো!
 
গল্পটা শুরু করেছিলাম কবিতা দিয়ে। শেষটাও কবিতা দিয়েই করা যাক। এই গাছটা আমাদের দেশের গ্রামের মানুষের প্রতিদিনের চেনা হলেও সাহিত্যিকরা কিন্তু খুব বেশি এর কথা বলেননি। তবে বাংলা সাহিত্যের ভুবনবিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের দু’টি কবিতায় সজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। কবিতা দু’টির নাম - ‘অঘ্রাণের প্রান্তর’ ও ‘বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি’। কবিতা দু’টি থেকে কয়েকটি মাত্র লাইন তোমাদের জন্য উল্লেখ করছি। দেখবে মনকে কী গভীর উদাস করে দেয় তার কবিতা।
 
‘...খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শাড়ির ভিতরে,
সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে
পতঙ্গ পালক জল- চারিদিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;
আলেয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কীরকম অবাধ আকাশ
হয়ে যায়...’
 
-অঘ্রাণ প্রান্তর
 
‘...আনারস বন;
ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝরে
মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়’ দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ করে,
নির্জন আমের ডালে দুলে যায়- দুলে যায়- বাতাসের সাথে বহুক্ষণ...’
 
-বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি
 
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার ‘চৈতী হাওয়া’ কবিতায় সজনে ফুলের কথা বলেছেন।

এই যে কবিতাগুলোর কথা বললাম সেগুলো খুঁজে বের করে পোড়ো কিন্তু তোমরা। আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ, জীবনানন্দ দাশ এবং কাজী নজরুল ইসলামের রচনাবলি পাড়া বা স্কুলের পাঠাগারে খোঁজ করলে পেয়ে যাবে আশা করি। ইন্টারনেটেও খুঁজতে পারো। তবে শুধু এই কবিতাগুলো নয়, পড়ো তাদের অন্য সব রচনাও। আশ্চর্য ভ্রমণের স্বাদ পাবে তাতে।
 
ফুলের প্রতি, গাছের প্রতি, সাহিত্যের প্রতি তোমাদের ভালোবাসা তৈরি হলে তবেই আমার এই ছবি তোলা আর লেখালেখির শ্রম সার্থক হবে!

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।