মুগরাব (কুয়েত) থেকে: ‘হিসাবে আমারে ২৪ ঘণ্টাই ডিউটি করুন লাগে। বিদেশে আইছি, উপায় নাই।
নিজের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বাসিন্দা মো. সোহরাব (৩৬)।
তিনি কাজ করেন কুয়েত সিটির মিরগাবের আল হেলাল মসজিদে। তত্ত্বাবধায়ক পদে। স্থানীয়ভাবে এ পদের নাম ‘হারেছ’।
তবে আমাদের দেশের মতো ঘড়ির কাঁটা ধরে ৮ ঘণ্টা কিংবা বাড়তি নির্দিষ্ট সময়ের কাজ নয়। ফজর ওয়াক্তের আগে রাত ৩টার দিকে শুরু হয় তার কাজ। আর শেষ হয় রাত ১০টায়। হিসাব করলে মোট ৫ ঘণ্টার বিরতি! তাহলে দৈনিক ডিউটি তো দাঁড়ায় ১৯ ঘণ্টা!
এ কথা শুনে স্মিত হেসে সোহবার বলেন, এর মধ্যেই খাই-দাই। আবার ঘুমাই!
গফরগাঁওয়ের ধুপাঘাট গ্রামের আব্দুল মতিনের ছেলে সোহরাব। ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। আগে গফরগাঁও বাজারে বিক্রি করতেন পান-সুপারি। তবে খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। ভাগ্য অন্বেষণে দালাল ধরে ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চলে আসেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে।
মোট ২ লাখ টাকার বিনিময়ে সুযোগ হয় কুয়েতে আসার। কাজ নেন হাওয়ালী জেলার একটি সড়কের ঝাড়ুদার হিসেবে। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘বুরুসমারা’। তখন বেতন ছিলো মাত্র ২০ কুয়েতি দিনার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার টাকা। খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার মতোও না। বাড়তি আয় বলতে বিত্তবানদের কাছ থেকে যে ‘বকশিশ’ ( হাদিয়া) পেতেন তাই দিয়ে নিজের ব্যয় মিটিয়ে অবশিষ্ট টাকা দেশে পাঠাতেন।
এভাবে ১০ বছর ধরে আছেন কুয়েতে। বর্তমানে যে মসজিদে তিনি কাজ করেন সেখানে এখন তার বেতন ৬০ দিনার। ২০ হাজার টাকারও কম।
তাহলে চলে কি করে? ‘মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসা বিত্তবানরা খুশি হয়ে যে দু’এক দিনার দেন, তার যোগফল দিয়েই টিকে আছি’। সহাস্য সোহরাবের উত্তর।
‘ধরেন কেউ আসলো, তাকে সালাম দিই। কিছু লাগবে কি না, বাড়তি সম্মান দিয়ে এগিয়ে যেতেই চুপিচুপি বকশিশ মেলে’-যোগ করেন সোহরাব। তবে শুক্রবার একটু বাড়তি ইনকাম হয়। কিন্তু রোজার সময় বলতে গেলে পুরো মাসে আয় হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা।
দিন কাটে কি করে? জানান, ‘রাত ৩টায় মসজিদ খুলি। এসি অন করি। লাইট জ্বালাই। কার্পেট পরিস্কার করি। নামাজ আদায় শেষে রাত ৪টায় মসজিদ থেকে বের হই। থাকি মুয়াজ্জিন ও ইমাম সাহেবের বরাদ্দ করা কক্ষের পাশেই। বেলা ১১টা পর্যন্ত ঘুমাই। বেলা ১২টায় যোহরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে মসজিদে চলে আসি। চলে একটানা রাত ১০টা পর্যন্ত। এর মধ্যেই সময় বাঁচিয়ে বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করি। বাজারে গিয়ে তালা-চাবি কিংবা অন্য কোনো মালামাল বিক্রি করি। এতে করেও কিছু অর্থ আয় হয়।
তিনি জানান, থাকা বাদে কোম্পানির কোনো দায়িত্ব নেই। খাওয়ার খরচা নিজের। বোনাস বা উৎসব ভাতা বলে কিছু নেই। ছুটিতে গেলে বেতনও নেই। দেশে গেলে বিমান ভাড়াও নিজের। ।
এখানে বাংলাদেশিদের বেতন তুলনামূলক কম। তবে এ বেতনে কোনো পাকিস্তানি কাজ করার ও আগ্রহ দেখায় না। অথচ আমাদের দেশের জন্যে ভিসাও বন্ধ। আক্ষেপ সোহরাবের।
৩ সন্তানের মধ্যে ২ ছেলেকে ‘মানুষ’ করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সোহরাব জানান, মরুভূমির দেশে কষ্ট করা তো পরিবারের সুখের জন্যে। বড় মেয়ে স্মৃতির বিয়ে হয়েছে। সম্প্রতি দেশে গিয়ে সদ্য ভূমিষ্ট নাতির মুখ দেখে এসেছেন। মেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন ময়মনসিংহ সেনানিবাসে।
বড় ছেলে সিহাব পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। আর ছোট ছেলে পিয়াস তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
প্রবাসী ‘অর্জন’ বলতে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় ৩ তলা বাড়ি নির্মাণ। নিজে বসবাস করে অন্য ফ্ল্যাটগুলোর ভাড়া আর প্রবাসী সঞ্চয় দিয়ে অবসর দিব্যি কেটে যাবে। ধূসর মরুভূমির বুকে বসে এমনই সবুজ স্বপ্ন আঁকেন সোহরাব।
বাংলাদেশ সময়: ০৬০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৫
এসআর
** ফেসবুক বন্ধ, খুললো জুতা!
** লেট বিমান!