ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

তাজরীন ট্রাজেডির এক যুগ: সাক্ষী না আসায় বিচারে ধীরগতি

খাদেমুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২৪
তাজরীন ট্রাজেডির এক যুগ: সাক্ষী না আসায় বিচারে ধীরগতি ফাইল ফটো।

ঢাকা: ঢাকা জেলাধীন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি বিচার। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১১২ শ্রমিক।

আরও অনেকেই আহত হয়। ওই অগ্নিকাণ্ডে স্বজন হারানো ব্যক্তিদের কান্না যেন থামছেই না। দেশের ইতিহাসে এই ঘটনা অন্যতম ভয়াবহ ট্রাজেডি হলেও বিচার নিয়ে রয়েছে ধীরগতি।

গত দুই বছরে মাত্র চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সাক্ষী না আসাকে বিচারে ধীরগতির মূল কারণ বলে উল্লেখ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। রাষ্ট্রপক্ষে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনজীবী বলছেন, বিচারে গতি আনতে তারা কাজ করবেন।

মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ নাসরিন জাহানের আদালতে বিচারাধীন। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের নামে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। বিচার শুরুর নয় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সাক্ষ্যগ্রহণে অগ্রগতি খুব সামান্য। রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। গত দুই বছরে মাত্র চারজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২২ অক্টোবর মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। তবে ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেনি। তাই আদালত আগামী ২৭ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।

দেশের ইতিহাসে এটি অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারায় অভিযোগ আনা হয়। তদন্তের পর ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন, তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপার ভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও কোয়ালিটি ম্যানেজার শহীদুজ্জামান দুলাল।

ওই ১৩ আসামির মধ্যে চারজন পলাতক এবং বাকি নয়জন জামিনে আছেন। পলাতক আসামিরা হলেন, মোবারক হোসেন মঞ্জু, রানা ওরফে আনারুল, শামিম মিয়া ও আল আমিন।

দীর্ঘ সময়েও মামলা শেষ না হওয়ায় বিচার ও ক্ষতিপূরণের আশা ছেড়ে দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন, সাক্ষ্য দিতে আদালতে গেলে তাদের হুমকি দিচ্ছেন গার্মেন্টসের মালিক দেলোয়ার ও তার স্বজনরা। তাই অনেক শ্রমিক পরিবারসহ আশুলিয়া এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ করছে, শ্রমিকরা সাক্ষ্য দিতে না আসায় মামলার বিচারেও অগ্রগতিও হচ্ছে না।  

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রবিউল ইসলাম রবি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষে আমি নতুনভাবে যোগ দিয়েছি৷ যোগদানের পর মাত্র একটি তারিখ পার হয়েছে। সেদিন কোনো সাক্ষী আসেনি। আমরা দ্রুত মামলার বিচারকাজ শেষ করার বিষয়ে সচেষ্ট থাকব।

সাক্ষী না আসার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মামলার সাক্ষীরা অধিকাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক। তারা যেহেতু দিন মজুর, সেহেতু চাকরির কারণে তাদের ঠিকানা বারবার বদল হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বারবার সমন দিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যারা গার্মেন্টসে চাকরি করেন, তাদের কাছে সমন পৌঁছালেও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আদালতে উপস্থিত হতে পারছেন না।

তিনি আরও বলেন, আমরা সাক্ষীদের ট্রেস করতে পারলে অবশ্যই গার্মেন্টস মালিকদের নোটিশ পাঠাতাম। রাষ্ট্রীয় খরচে সাক্ষীদের আদালতে আনার ব্যবস্থাও করতাম। কিন্তু আমরা তাদের সঠিক ঠিকানায় খুঁজে পাচ্ছি না। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, সাক্ষ্য হাজির করে খুব শিগগিরই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে পরবর্তী কার্যক্রমের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবো।

মামলায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে আসামিরা হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে দাবি আসামিপক্ষের আইনজীবীদের।

আসামি দুলাল, হামিদুল, আনিস ও আল আমিনের আইনজীবী রোকেয়া বেগম বলেন, এ মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষী আদালতে ভুল সাক্ষ্য দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনও সঠিক না। দীর্ঘদিন মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। আর যদি সাক্ষী আসে তবে মামলার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। কারণ আসামিদের চাকরি ফেলে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারাও আমার আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেননি। আইনগত দিক বিবেচনা করে মামলা নিষ্পত্তি হলে তারা নির্দ্বিধায় খালাস পাবেন বলে আমাদের আশা।

তাজরীন ফ্যাশনের মালিক দেলোয়ারের আইনজীবী হেলেনা পারভীন জানান, আমরাও চাই মামলাটি দ্রুত বিচার শেষে হোক। বিচার যতই দেরিতে শেষ হবে ততই উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রপক্ষ ঠিকমতো সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারছেন না। এজন্য সাক্ষ্যগ্রহণও শেষ হচ্ছে না। দীর্ঘদিন মামলাটি চলমান থাকায় আসামিরা মানসিক ও আর্থিকভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হলে আসামিরা ন্যায়বিচার পাবেন।

তিনি বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদনেই এসেছে, এটা একটি দুর্ঘটনা মাত্র। কেউ কি আর ইচ্ছে করে ২৫০/৩শ কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করবে। আশা করি, মামলাটির রায় ঘোষণা হলে মালিক-কর্মকর্তা-শ্রমিক সবাই খালাস পাবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২৪
কেআই/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।