ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

ছাত্র রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়-দায়িত্ব

মোঃ জাহিদ হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৪
ছাত্র রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়-দায়িত্ব

গত কয়েক মাস ধরে হরতাল অবরোধের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো ক্লাস পরীক্ষা হয়নি। কিন্তু নির্বাচনের পরে প্রাণ প্রিয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মুখরিত হতে না হতে আবার রক্তাক্ত হয়ে পড়ে।



সম্প্রতি সিলেটে শিবির কর্তৃক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের এক কর্মীর রগ কর্তনের অভিযোগ ও পরে এ ইস্যুতে ছাত্রলীগের হল দখলকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে ক্যাম্পাসে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।

এতে উভয় পক্ষের ২০/২৫ জন আহত হওয়া ছাড়াও ১ শিবির কর্মী নিহত হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। লাঞ্ছিত করা হয় প্রক্টরসহ সাংবাদিকদের।

ফলশ্রুতিতে এতো দিন পর খুলতে না খুলতে আবার অশান্ত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। স্থবির হয়ে যায় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম।

এইভাবে এমন করে গত ২৬ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটল যাতে প্রাণ হারায় ছাত্রলীগ, ছাত্রশিবিরসহ ছাত্রদল, ছাত্রমৈত্রী এবং ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মী।

যাহোক, নির্বাচনের পর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণের যে উচ্ছ্বাস ফিরে এসেছিল তাতে আবার রাজনৈতিক কোন্দলে প্রাণ হারাতে হয়েছে এক মেধাবী শিক্ষার্থীকে হোক না সে ছাত্রলীগ অথবা ছাত্রশিবির কিংবা কোন সাধারণ ছাত্র।

কারণ এসব পরিচয়ের বাইরে সে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী, একজন মায়ের কোলের সন্তান। আর আমরা কিছু দিন পর পর হারিয়ে ফেলছি নষ্ট এই ছাত্র রাজনীতির বলি হওয়া ক্যাম্পাসের সেই চিরচেনা মুখগুলো।

ঘটনা ঘটার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু প্রতিবারের মত শুধু তদন্ত কমিটিই গঠিত হয়। সঠিক রিপোর্ট বের হয় না। বের হলেও কার্যকর হয় না।

এই পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক সহিংসতার যত ছাত্র নিহত হয়েছে তার অধিকাংশের কোন বিচার হয়নি। তাই দায়ীদের শাস্তি না হওয়ায় বারবার একই ঘটনা ঘটছে। এ থেকে বুঝা যায় কর্তৃপক্ষের কতটা অবহেলা ছিল!

তাই আইন অনুযায়ী অবহেলার দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপরই বর্তায়। এই সব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনার রহস্য উম্মোচনের জন্য ঘটিত তদন্ত কমিটিও কিছু দিন পর নিস্ক্রিয় হয়ে যায় বিভিন্ন অদৃশ্য কারণে।

বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি ঘটন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। এই ভাবে প্রতি বছর হত্যাকাণ্ড ঘটবে, তদন্ত কমিটি ঘটিত হবে, ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হবে, এই ভাবে চলতেই থাকবে।

কিন্তু ফলাফল কি, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর একই প্রশ্ন – এসবের শেষ কোথায়? তাছাড়া কোন অপরাধের বিচার না হওয়া মানে সেই অপরাধ করতে অপরাধীদের আরও উসকিয়ে দেওয়া নয় কি? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কখনো এইসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেনা।

যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পূর্ব থেকে উপলব্ধি করে থাকে যে নির্বাচনের পর ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন ধরণের সংঘর্ষ বাঁধতে পারে তাহলে কেন পূর্ব থেকে কড়াকড়ি আরোপ করে ক্যাম্পাসে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দিল না? কারণ কোন ছাত্র যেই রাজনৈতিক দলের হোক না কেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে সে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে।

এর জন্য প্রশাসনের প্রয়োজনে যে কোন পন্থা অবলম্বন করা উচিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী যদি কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে তাহলে তাঁকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হোক, প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কার করা হোক।

কিন্তু তাই বলে বিভিন্ন সরকারের আমলে পুলিশ সহায়তায় একটি রাজনৈতিক দলকে আরেকটি রাজনৈতিক দলের উপর গুলি ও হামলা করতে ছাড় দেওয়া কতটা যৌক্তিক!

ঘটনার দিন প্রথমে ছাত্রলীগের চাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমানত হল থেকে পুলিশ কর্তৃক শিবির হিসেবে সন্দেহভাজন ১৮ জনকে আটক করার পরও আবার কোন উস্কানি ছাড়াই ঐ হলে ছাত্রলীগ কর্তৃক হামলাতে কিছু ছাত্রকে কুপিয়ে জখম করা কি খুবই প্রয়োজন ছিল? দুই শতাধিক পুলিশের সামনে অস্ত্র-বোমা হাতে একপক্ষ অন্যপক্ষের ওপর হামলা চালায় কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব ছিল কেন? তাঁরা তো পারত সংঘর্ষ এড়াতে।

হাতের কাছে পেয়েও তখন কোন অস্ত্রধারীকে আটক করেনি পুলিশ। যার কারণে ধারালো অস্ত্রের আঘাতেই খুন হয় এক ছাত্র। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের কড়া নিরাপত্তা থাকার পরও ক্যাম্পাসে তাঁদের সামনে একের পর এক হত্যা কাণ্ড কিভাবে হচ্ছে তাও বোধগম্য নয়।

আবার কোন সাধারণ ছাত্র নিহত হলেও তাঁকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় লাশের রাজনীতি। এ বলে তাঁদের কর্মী তো ও বলে ওদের কর্মী। আসলে দেখা যায় নিহত ছাত্রটি নিতান্তই সাধারণ শিক্ষার্থী। অতীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সাথে ছাত্র শিবিরের সংঘর্ষের সময় নিহত এক ছাত্রকে নিজ নিজ দলের কর্মী বলে দাবি করেছিল উভয় দল।

প্রতিবারের মত এবারও ক্যাম্পাস হঠাৎ করে এই ধরণের সংঘর্ষ হওয়ার পেছনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন(সূত্রঃ দৈনিক আজাদী)।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে পুলিশ পুলিশের দায়িত্ব ঠিক মত পালন না করলে প্রশাসনের কি করার আছে। আর এইদিকে এই ব্যাপারে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করবে আর পরে সাংবাদিকদের কাছে কোন মুখ খুলতে নারাজ হবে এমন হলে তো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে বিভিন্ন হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক নিরাপত্তা কে নিশ্চিত করবে? এসব ঘটনার পর পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উভয়ের গা বাঁচানো বক্তব্য দেয় মিডিয়ার কাছে।

বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শুধু বিচারের আশ্বাসই দিয়ে যায় কিন্তু বাস্তবে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। অন্তত আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এই চার বছরে তা দেখিনি।

যাহোক, এখন প্রশ্ন হল শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি উচ্চ শিক্ষার জন্য আসে নাকি রাজনীতি করার জন্য আসে তাও আবার অস্ত্রের রাজনীতি! আর মাঝখান দিয়ে জাতি হারায় কিছু সম্ভাবনাময় মেধাবী শিক্ষার্থী। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সারাক্ষণ থাকে আতঙ্কে।
এছাড়াও ছাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একেক বার একেক সংঘর্ষ বাঁধে আর ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে থাকে মাসের পর মাস। এতে করে সেশন জটের কারণে শিক্ষার্থীরা তাঁদের জীবন থেকে হারায় অনেক মূল্যবান সময়।
যে কোর্স শেষ হওয়ার কথা ছিল চার বছরের মধ্যে তা আজ এই নষ্ট ছাত্র রাজনীতির জন্য গিয়ে গড়ায় ছয় থেকে সাত বছরে।

স্বাভাবিকভাবে যে দল ক্ষমতায় থাকবে সেই দলই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজত্ব করবে এমনটা দেখা যায়। তাই বলে আমরা বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট দখল, আদিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজি, হত্যা, বোমাবাজী কিংবা সন্ত্রাসীর রাজনীতিই দেখে যাব?
তাহলে কেন এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য! বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ না হলেও কার্যত অচল হয়ে আছে। আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে যাচ্ছে না। আমারা চাই না প্রতি বছর এমন করে ক্যাম্পাসে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আমাদের পড়াশুনা বাধাগ্রস্থ হোক।

প্রয়োজন হলে শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া হোক। এছাড়াও আশা করি এখন থেকে সরকারও প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রে বিশ্বজিৎ এর মত উদাহরণ সৃষ্টি করে সকল মহলের প্রশংসা অর্জন করবে।
  
লেখকঃ ছাত্র, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও মানবাধিকার কর্মী

বাংলাদেশ সময়: ৯২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।