আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং কোনো রকমের বৈষম্য ছাড়াই সকলে আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। ’
সেই সাথে ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ ভেদে অথবা জন্মস্থানের কারণে কারো প্রতি বৈষম্য করা যাবে না।
সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা আছে, সব নাগরিক সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী, তবে সংবিধানে বর্ণিত এই সমান অধিকার বা সমান আইনি প্রতিকার পাওয়ার অধিকার শুধু সংবিধানের কাগুজে-কলমে সীমাবদ্ধ, বাস্তবতায় রয়েছে ভিন্নতা।
এই ভিন্নতার পেছনে রয়েছে আর্থ-সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় কারণ।
হিন্দু ধর্মের বিধান মতে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিষ্কার বিধান না থাকায় সবাইকে তাদের নিয়মকানুন মেনে চলতে হচ্ছে।
হিন্দু আইনে তালাক দেওয়ার কোনো বিধান না থাকায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়না। কিন্তু স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীর ভরণপোষণ দেবে কে? কীভাবে কাটবে তার বাকি জীবন।
যদি কারো স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে তবে কেন স্ত্রী পারবে না? এটি একটি মানবিক প্রশ্ন।
আবার মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী, নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের যেমন অধিকার আছে (কাবিননামার ১৮ নম্বর ঘরের শর্ত সাপেক্ষে), হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো আইন নাই।
ভরণপোষণের ক্ষেত্রে অবশ্য দুই ধর্মেই ভরণপোষণ সংক্রান্ত আইন রয়েছে।
মুসলিম আইনে নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারেন এবং সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার তাঁদের রয়েছে। কিন্তু হিন্দু আইনে উত্তরাধিকারী হলেও ক্ষেত্র খুবই সীমিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত দায়ভাগ মতবাদে হিন্দু নারীরা জীবনস্বত্বে এবং স্ত্রীর মালিকানাধীন এ দুভাবে উত্তরাধিকারী হতে পারেন।
জীবনস্বত্বের ক্ষেত্রে এ সম্পত্তি কোনো নারী বেঁচে থাকা পর্যন্ত ভোগদখলের এখতিয়ার লাভ করেন। কিন্তু আইনগত কারণ ছাড়া এ সম্পত্তি তিনি হস্তান্তর করতে পারেন না।
তাঁর মৃত্যুর পর ওই সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারীর ওপর না বর্তিয়ে যাঁর কাছ থেকে এটি পেয়েছিলেন তাঁর নিকটবর্তী উত্তরাধিকারীর কাছে চলে যায়।
তবে স্ত্রীর নিজস্ব কোনো সম্পত্তি হলে তা তাঁর উত্তরাধিকারীর মধ্যে বর্তাতে পারে।
ভারতে ১৯৫৬ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত আইন পাস হওয়ার পর পিতার মৃত্যুর পর পুত্র ও কন্যা সমান অংশ লাভ করে।
মুসলিম আইনে সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে পিতাই সন্তানের আইনানুগ অভিভাবক।
তবে মা সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত দেখাশোনা করতে পারেন।
হিন্দু আইনে বাবার পর মা সন্তানের অভিভাবক হতে কোনো বাধা নেই।
প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে, ফৌজদারি কোনো অপরাধ যেমন- চুরি, মারামারি কিংবা খুনের জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র ভেদে কোনোরকম বৈষম্য প্রদর্শণ করা না হয় তবে কেন বিয়ের ক্ষেত্রে এ জাতীয় বৈষম্য মেয়েদের মেনে নিতে হবে।
পাশাপাশি হিন্দু বিয়েতে রেজিস্ট্রেশনে কোনো বিধান নেই ফলে বিয়ে তালাক কিংবা একই স্বামীর একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনি সহায়তা পান না হিন্দু নারীরা।
অথচ বিয়ের ক্ষেত্রে মুসলিম আইনে রয়েছে রেজিষ্ট্রির বিধান।
বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন আইন অনুযায়ী, এ বিধান না মানা হলে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু নির্যাতনের শিকার হিন্দু নারীরা এ ক্ষেত্রে প্রতিকার পায় না।
অনেকেই এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ের সমর্থননামা সম্পন্ন করে থাকেন।
কিন্তু রেজিষ্ট্রেশন আইন না থাকায় এটিরও ভিত্তি তেমন থাকে না। অথচ ভারতে হিন্দু বিয়েতে রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অন্যদিকে খ্রিস্টান ধর্ম মতে, বিয়ে সামাজিক বন্ধন। যার মাধ্যমে নারী-পুরুষ তাদের বংশ বিস্তার করতে পারে।
পাশাপাশি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম মতে বিয়ে একটি ধর্মীয় বিষয়।
এ ছাড়া মুসলিম বিয়েতে স্ত্রীরা স্বামীর কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মোহরানা পায় এবং বিবাহবিচ্ছেদ হলে তিন মাসের খোরপোষ (ভরণপোষণ) পায়; কিন্তু অন্য ধর্মে এ জাতীয় কোনো বিধান নেই।
মুসলিম বিয়ে একটি চুক্তি হিসেবে গণ্য হওয়ায় বিয়ের কাবিননামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হয়, মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করলে তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ; কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কোনো আইন আমাদের দেশে হয়নি।
কয়েক বছর আগে আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আইন কমিশন হিন্দু আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে হিন্দু বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন, বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার-সম্পর্কিত বিধানগুলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৫ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৪
লেখকঃ সাংবাদিক ও আইনজীবী।