মুসলিম আইনে বিয়ে এক প্রকার দেওয়ানি চুক্তি হওয়ায় বিয়ের সময় এই চুক্তির শর্তাবলি ঠিকঠাক করে নেয়া বর ও কনে পক্ষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মোহর ও বিয়ে-বিচ্ছেদের অধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে স্পষ্ট মতৈক্যে পৌঁছানো এবং সেই মোতাবেক লিখিত দলিল প্রস্তুত করে নেয়া জরুরি।
অন্যথায় পরবর্তীতে দাম্পত্য সম্পর্কে নানামুখী তিক্ততা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে।
ইসলামী আইনে বিয়ে হলো একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে পবিত্র বন্ধন। ধর্মীয় ও সামাজিক উদ্দেশ্য ছাড়াও এ বন্ধন সৃষ্টি হয় একটা আইনগত চুক্তির মাধ্যমে। বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও বৈধ সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে। এ ছাড়াও বিয়ের মাধ্যমে তাদের একে অন্যের ওপর যাবতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য জন্মায়।
যা হোক, বিয়ে করতে হলে বা বিয়ে দিতে হলে প্রথমে দেখতে হবে পাত্র-পাত্রীর আইনে বর্ণিত উপযুক্ত বয়স হয়েছে কি না। কারণ বিয়ের সময় পাত্রের বয়স যদি ২১ বছরের নিচে এবং কনের ১৮ বছরের নিচে হয় তখন আইনে সেটিকে 'বাল্যবিয়ে' বলে ধরা হবে। আর বাল্যবিয়ের শাস্তি হলো এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি।
যে বা যারা বিয়ে দেবে এবং তাতে যে বা যারা সাহায্য করবে এ শাস্তি তাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য।
মুসলিম বিয়েতে পাত্র-পাত্রী উভয়কে যে শর্তগুলো পালন করতে হবে তা হলো
১. বিয়ের এক পক্ষ বিয়ের প্রস্তাব দেবে।
২. অন্য পক্ষকে তা গ্রহণ করতে হবে।
৩. যারা সুন্নি সম্প্রদায়ের তাদের ক্ষেত্রে দুজন সাক্ষী থাকতে হবে আর শিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সাক্ষী না থাকলেও বিয়ে সম্পন্ন হবে। সাক্ষী দুজন পুরুষ হবে অথবা দুজন মহিলা ও একজন পুরুষ থাকলেই চলবে।
৪. বিয়ের সময় পাত্র ও পাত্রীর মুখে উচ্চারিত 'কবুল' শব্দটি স্পষ্ট হতে হবে এবং উভয়ে কোনো রকম চাপ বা প্ররোচনা ছাড়াই তা স্বেচ্ছায় বলবে।
৫. একই বৈঠকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হবে এবং গ্রহণ করতে হবে। এক বৈঠকে প্রস্তাব দিলে আর অন্য বৈঠকে প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে তা কখনো বৈধ বিয়ের মর্যাদা পাবে না।
৬. মুসলিম আইনে কোনো পক্ষেরই বিয়ের জন্য কোনো ধর্মীয় কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক নয়।
কাবিননামা
কাবিননামায় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে পালনীয় শর্ত উল্লেখ থাকবে। দেনমোহরের পরিমাণ কত হবে তার উল্লেখ থাকবে। আর কাবিননামায় স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দেয়া যেতে পারে। এতে পরবর্তীতে স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে কোনো কারণে সংসার করতে না পারে তাহলে আইন অনুযায়ী স্ত্রী তার স্বামীর পৃথক অনুমতি ছাড়াই তালাক নিতে পারবে।
দেনমোহর
দেনমোহরের পরিমাণ উভয় পক্ষ মিলে ঠিক করবে। এটা নির্ভর করে পাত্র-পাত্রীর সামাজিক ও শিক্ষাগত মর্যাদার ওপর। কাবিনে দেনমোহরের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। তবে কোনো কারণে দেনমোহর ঠিক না করে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলে পরে তা নির্ধারণ করে নেয়া যাবে। মুসলিম আইনে দেনমোহরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নগদ দেনমোহর আর বাকি দেনমোহর। কোনটা কতটুকু হবে তা পাত্র ও পাত্রী পক্ষ আলোচনা করে ঠিক করে নেবে।
বিয়ে সম্পন্ন করার সময় কাজির উপস্থিতিতে নগদ দেনমোহর স্বামী সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করবে, যদি স্ত্রী তেমনটি চায়। পুরোটা পরিশোধ না করলে বাকি দেনমোহর ইচ্ছা করলে পরে আদায় করা যাবে। দেনমোহর কিভাবে পরিশোধ করা হবে, তা স্পষ্ট করে ঠিক করা না হলে পুরোটাই নগদ দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে। তখন স্ত্রী চাওয়ামাত্র স্বামী তা দিতে বাধ্য থাকবে। এরকম অবস্থায় স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহরের অর্থ আদায় করার জন্য আইনের আশ্রয়ও নেয়া যাবে। তা ছাড়া স্ত্রী তার সম্পূর্ণ দেনমোহর আদায় না করা পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে সহবাস করতেও অস্বীকৃত হতে পারবে।
বিয়ে রেজিস্ট্রেশন
বিয়ের প্রমাণ কাগজ-কলমে লিখে লিপিবদ্ধ করাই হলো রেজিস্ট্রেশন। এটি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফরমে লিখিত বিয়েসংক্রান্ত দলিল, যা কাজি অফিসে সংরক্ষিত থাকে। যে কোনো মুসলিম বিয়ে সরকার অনুমোদিত রেজিস্ট্রার কর্তৃক রেজিস্ট্রি করতে হবে। বিয়ে রেজিস্ট্রি না করা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪-এর ধারা-৫(৪) অনুসারে, বিয়ে নিবন্ধন না করলে এর জন্য দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৩ হাজার টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যায়।
প্রশ্ন আসতে পারে, বিয়ে নিবন্ধনের এত প্রয়োজন কী? বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা না হলে আমাদের দেশে মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি ঠকে।
বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হলে বেশকিছু সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন, প্রথমত, কেউ বিয়ের সত্যতা অস্বীকার করতে পারে না; দ্বিতীয়ত, স্ত্রীর তালাকের অধিকার পাওয়ার জন্য; তৃতীয়ত, দেনমোহর পাওয়ার জন্য; চতুর্থত, ভরণ-পোষণ পাওয়ার জন্য; পঞ্চমত, ছেলে-মেয়ের দেখাশোনা ও অভিভাবকত্ব নির্ধারণের জন্য; ষষ্ঠত স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হওয়ার জন্য।
অতএব বোঝা যাচ্ছে, ওপরের সমস্যাগুলোর আইনগত সমাধানের জন্য বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। তা ছাড়া রেজিস্ট্রেশন না করার সুযোগে খারাপ চরিত্রের পুরুষের দ্বারা অনেক সময় তার স্ত্রীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তখন স্ত্রী প্রতিকার পায় না। আর বিয়ের সত্যতা প্রমাণের জন্য বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কপিটিই যথেষ্ট। রেজিস্ট্রেশন ফরমে কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য দেয়া যাবে না। পরে প্রমাণ হলে আবার সাজা হতে পারে সংশ্লিষ্ট পক্ষের।
এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করা যাবে না। অর্থাৎ পরবর্তী বিয়ে করার জন্য আগের স্ত্রী বা স্ত্রীদের থেকে অনুমতি নিতে হবে এবং ওই অনুমতির একটি কপি স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বা চেয়ারম্যানকে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, লাইসেন্স নেই এমন কোনো কাজির কাছে বিয়ে নিবন্ধন করলে সেই বিয়ের কোনো আইনগত ভিত্তি থাকে না।
এ ছাড়াও বিয়ে নিবন্ধনের সময় কিছু বিষয়ে পক্ষগুলোকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন:
১. বিয়ের মঞ্চেই বিয়ে নিবন্ধন করতে হয়।
২. বিয়ের মঞ্চে সম্ভব না হলে বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে নিবন্ধন করতে হয়।
৩. কাজিকে বাড়িতে ডেকে এনে কিংবা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে নিবন্ধন করা যায়।
৪. কাবিননামার সব শর্ত যথাযথ পূরণ করার পর বর-কনে, উকিল সাক্ষী ও অন্য সব ব্যক্তির স্বাক্ষর নিতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় ছেলে-মেয়েরা একে অন্যকে ভালোবেসে কোর্ট ম্যারেজ করে ফেলে। কিন্তু আইনে কোর্ট ম্যারেজ বলে কোনো শব্দ নেই। আবেগে পড়ে এভাবে আদালতে হলফনামা করলেই বিয়ে হয়ে যায় না। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে 'কোর্ট ম্যারেজ'-এর কোনো বৈধতা নেই। দেখা যায় ছেলে-মেয়েরা ৫০, ১৫০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কাছে গিয়ে এফিডেভিট বা হলফনামা করে। কিন্তু এটা বিয়ে নয়, বিয়ের ঘোষণামাত্র। আবার বয়স ১৮ বা ২১ না হলেও কিছু বিজ্ঞ আইনজীবীর এ ব্যাপারে জানা সত্ত্বেও টাকার জন্য এটিকে বৈধ বলে স্বীকৃত দেয়া নিতান্তই বেআইনি।
লেখক : আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক লেখক ও গবেষক। ইমেইল: zahidlawcu@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫