বুধবার (১৫ মে) বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।
বুধবার শুনানির শুরুতেই দুদকের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, আমাদের কাছে তো রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট না আসলে অ্যাকশনে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এ সময় আদালত বলেন, কোন কোন কোম্পানির দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যে ভেজাল রয়েছে তা চিহ্নিত করতে চাই।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম বলেন, সাবস্ট্যান্ডার্ড বলতেই যে হার্মফুল এমন কিন্তু নয়। তাই সাবস্ট্যান্ডার্ড বিষয়টা নিয়ে ঢালাওভাবে বলে ফেললে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়।
তখন আদালত বলেন, এ যে রিপোর্টগুলো (গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন) আপনারা দেখেন? দেখার পর কি আপনাদের বিবেক জাগ্রত হয় না? আপনারা একটু কি টেস্ট করে দেখবেন না?
জবাবে ফরিদুল ইসলাম বলেন, গত সপ্তাহেই আমরা কমিটি করেছি। এক মাসের মধ্যে সব টেস্ট করে রিপোর্ট দিতে পারবো বলে আশা করি।
বিএসটিআই’র আইনজীবী সরকার এম আর হাসান বলেন, প্রফেসর শাহনীলা ফেরদৌসী যে রিপোর্ট করেছেন সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। ওই রিপোর্ট করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের জানা নেই। বিএসটিআই তো একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ডকে মেইনটেইনের মাধ্যমে পরীক্ষা করে রিপোর্ট করে। তিনিতো ঢাকা এবং তিন জেলার ছয়টি উপজেলাসহ ১৮টি স্থান থেকে দুধের পাশাপাশি অন্যান্য নমুনাও সংগ্রহ করে রিপোর্টটি করেছেন। এখানে তো সারা দেশের সামগ্রিক চিত্র নাও উঠে আসতে পারে। আর এই সব রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আতঙ্ক তৈরি হয়।
এ সময় আদালত বলেন, এটা বলতে হবে যে, মিডিয়াতে এই সব ভেজাল বিষয় উঠে আসার কারণেই আমরা বিষয়গুলো জানতে পারি। তাই মিডিয়াকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। তারা বিষয়গুলো সামনে না নিয়ে এলে আমরা তো জানতেই পারতাম না।
‘মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যাবে না। মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে জীবন থেকে লাভ কি? এসব ব্যপারে কোনো ছাড় দিব না। ’
আদালত বিএসটিআই’র আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা কবে রিপোর্ট দেবেন, কতদিন সময় লাগবে? আইনজীবী বলেন, এক মাস।
আদালত বলেন, আপনারা কী দেবেন? জবাবে আইনজীবী সরকার এম আর হাসান বলেন, আমরা যাদের লাইসেন্স দিয়েছি তাদের নাম, তাদের উৎপাদিত দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য পণ্যের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট এবং পরীক্ষায় ভেজাল পেলে সে ক্ষেত্রে যারা জড়িত তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরব।
এরপর আদালত প্রতিবেদন দিতে বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে ২৩ জুন পর্যন্ত সময় দিয়ে ওইদিন পরবর্তী আদেশের জন্য রাখেন।
আদেশের পরে আমিন উদ্দিন মানিক সাংবাদিকদের জানান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ও বিএসটিআই এর আইনজীবী বিস্তারিতভাবে নামসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় প্রার্থনা করেন। দুদকের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআই জড়িত কোম্পানির নাম না দেওয়ায় দুদক কাজ শুরু করতে পারছে না বলে আদালতকে জানান।
তিনি আরও বলেন, আদালত শুনানি শেষে বলেন- মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না , মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক অনুজীবসহ দুধ-দই উৎপাদনকারীদের শাস্তি হতে হবে। সাধারণ মানুষকেও এসব জানিয়ে সচেতন করতে হবে। রিপোর্টের বিষয় ওয়েব সাইটেও দিতে হবে।
আদালত দেখেন গত ১১ ফেব্রুয়ারি আদেশে ন্যাশানাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রধান প্রফেসর শাহনীলা ফেরদৌসীকে নোটিশ জারির ১৫ দিনের মধ্যে তার গবেষণালব্দ রিপোর্টটি আদালতে জমা দেওয়ার আদেশ পালন করেননি। আদালত প্রফেসর শাহনিলা ফেরদৌসীকে ২১ মে সকাল সাড়ে দশটায় আদালতে শরীরে উপস্থিত হয়ে তার রিপোর্টটি আদালতে জমা দিতে আদেশ দেন। আর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআইকে ক্ষতিকারক দুধ ও দইয়ের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নামসহ তাদের গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন ২৩ জুন আদালতে দাখিল করতে আদেশ দিয়েছেন বলে জানান এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘গাভির দুধ ও দইয়ে অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক, সিসা!' শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাভির দুধে (প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া) সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ও নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের উপাদান পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে বিভিন্ন অণুজীবও। একই সঙ্গে প্যাকেটজাত গাভীর দুধেও অ্যান্টিবায়োটিক ও সীসা পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত। বাদ পড়েনি দইও। দুগ্ধজাত এ পণ্যেও মিলেছে সীসা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) গবেষণায় এসব ফলাফল উঠে এসেছে। সংস্থাটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গাভীর খাবার, দুধ, দই ও প্যাকেটজাত দুধ নিয়ে এ জরিপের কাজ করেছে।
ওই প্রতিবেদন নজরে আসার পর ১১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট স্বতপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন।
আদেশে গাভীর দুধ (প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া) ও বাজারের প্যাকেটজাত দুধ, দই এবং গো খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে তাতে কি পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, সীসা, রাসায়নিক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর তা নিরূপণে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এই কমিটিকে প্রতি ৬ মাস পরপর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। নিজেদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য মানুষ যাতে সঠিক তথ্য সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের এই আদেশ কার্যকর করতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, খাদ্য, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ সচিবের কাছে আদেশের অনুলিপি সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুধ, দই ও গো-খাদ্যে ভেজাল মেশানোর ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে দুধ, দই এবং গো-খাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে একটি কমিটি গঠন করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কমিটিকে তিনমাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এছাড়া জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের কারিগরি ব্যবস্থাপক অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসের প্রতিবেদন ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রুলে নিরাপদ দুধ, দই ও গো-খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ও ভেজাল প্রতিরোধে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি এবং অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ভেজাল দুধ, দই ও গো খাদ্য উৎপাদন, পরিবহন, প্যাকেটজাতকরণ, বাজারজাতকরণ এবং সংরক্ষণ করা কেন বেআইনী ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও খোলাবাজার থেকে এসব ভেজাল দুধ, দই ও গো-খাদ্য অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।
ওই আদেশের পর ৮ মে বুধবার নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম আদালতে ১৬ সদস্যের কমিটি গঠনের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
পরে ফরিদুল ইসলাম বলেছিলেন, ১৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কর্মপরিধিও তৈরি করেছেন। এর মধ্যে দুধ, দই ও পশুখাদ্যে ভেজাল মেশানোর সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করার বিষয়টি যোগ করতে বলেছেন। এছাড়াও কমিটির ফাইনাল রিপোর্টে যেন জড়িতদের নাম থাকে সেটি বলেছেন আদালত।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৭ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হকের সভাপতিত্বে একটি জরুরি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যালোচনাক্রমে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. মাহবুব কবিরকে আহ্বায়ক করে ১৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির পরবর্তী কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, এক. চার সপ্তাহের (২৪ এপিল থেকে আগামী ২২ মে) মধ্যে কাঁচা, তরল ও পাস্তুরিত দুধের নমুনা সংগ্রহ, গবেষণাগারে পরীক্ষা ও কমিটির ফলাফল পর্যালোচনা; ২. পশু খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ এবং গবেষণাগারে পরীক্ষা ও কমিটি কর্তৃক ফলাফল পর্যালোচনা (২৩ মে থেকে ২২ জুনের মধ্যে); ৩. (২৩ মে থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে) প্রাথমিক উৎপাদন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ, ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং কমিটির যথাযথ সুপারিশ প্রণয়ন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০১৯
ইএস/এএ