ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আইন ও আদালত

সুপ্রিম কোর্টে মতামত দিয়েছেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০
সুপ্রিম কোর্টে মতামত দিয়েছেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

ঢাকা: ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) আর্থিক অবস্থার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মতামত তুলে ধরেছেন স্বাধীন চেয়ারম্যান (হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত) খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

একই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালকের মতামত শোনার পর মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ আদেশের জন্য বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দিন রেখেছেন।  
 
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের আর্থিক অবস্থার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে কোম্পানিটির স্বাধীন চেয়ারম্যান (হাইকোর্টের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত) খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তাকে ডেকেছিলেন আপিল বিভাগ।

সে অনুযায়ী তারা দুইজন মঙ্গলবার আপিল বিভাগে উপস্থিত হন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম।
 
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড ২০১৫ সাল পর্যন্ত খুব ভালমতো চলছিল। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে এর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এর পেছনে ‘কি পারসন’ (মুখ্য ব্যক্তি) হিসেবে কাজ করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার)। তার সঙ্গে আরও অনেকেই রয়েছেন। এরা একসঙ্গে অনেক শেয়ার কিনে কোম্পানিটির আগের নেতৃত্বকে বের করে দিয়েছেন। বের করে দেওয়া মানে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে অথবা ছাঁটাই করা হয়েছে।
 
তিনি বলেন, পিকে হালদারসহ কিছু ব্যক্তি এই কোম্পানি থেকে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তা লেখা আছ। তলিয়ে দেখতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ কোন ব্যক্তি পর্যন্ত এই টাকা পৌঁছালো তা জানি না। এই টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। টাকা কোথায় আছে সেটা আনট্রেসেবল (হদিস পাওয়া যাচ্ছে না)। দেশেও থাকতে পারে দেশের বাইরেও যেতে পারে। তবে এই টাকা উদ্ধার করতে রিকভারি অ্যাজেন্ট নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের অ্যাজেন্ট দিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে।
 
তার মতে, পিপলস লিজিংকে অবসায়ন করা হয়েছে। এখন যদি একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটডকেও অবসায়ন করা হয় তাহলে আর্থিক খাতে ধস নামতে পারে।
 
কোম্পানিটিকে কতটা দাঁড় করানো যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ ডেপুটি গভর্নর বলেন, আমি সাহস পাচ্ছি না। আমিতো এই কোম্পানির কোনো শেয়ার হোল্ডার নই। হাইকোর্টের আদেশে আমাকে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান করা হয়েছে। বাইরে থেকে এসে আমি এটাকে কতটা দাঁড় করাতে পারবো!
 
এ সময় আদালতের জিজ্ঞাসার জবাবে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, টাকাতো নাই। তারা (আমানতকারী) চাইলেও টাকা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। পয়সাতো নেই।  
 
আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম  বলেন, এই কোম্পানিটির মূলধনে ৪৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংক ঋণ আছে ৯৫৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সর্বমোট ঋণ হচ্ছে ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা।  
 
তিনি বলেন, নতুন নিযুক্ত স্বাধীন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কোম্পানিটি পুনর্গঠন করা সম্ভব বলে মনে করছি।
 
তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা দেখলাম একজনই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আপনাদের হিসাব কি শুভঙ্করের ফাঁকি?
 
নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, পিকে হালদারসহ অন্যরা এই কোম্পানি থেকেই সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আমরা পাইনি।  
 
অপরদিকে ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম এই অনিয়মের জন্য কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ, প্রধান নির্বাহী, নির্বাহী কমিটি, নিরীক্ষা কমিটি, ঋণ-ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, আভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা পরিপালন বিভাগ সম্মিলিতভাবে দায়ী বলে উল্লেখ করেন।
 
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে বলেন, কিছু লোক কিছু লেখাপড়া শিখে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। এরা হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। এদের কাজই হচ্ছে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। পিকে হালদার কীভাবে চলে গেল সেটা আপনাদের (আদালতের) দেখা উচিত। কোম্পানি চলবে কি চলবে না, সে বিষয়ে আপনারা সিদ্ধান্ত নেন।
 
আহসানুল করিম বলেন, কোম্পানি অবসায়নের কথা এসেছে। কোম্পানি যদি ভেঙে যায় তাহলে কিছু থাকবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলেছে কোম্পানি পুনর্গঠনের কথা। অবসায়ন হয়ে গেলে আর ব্যবসা থাকবে না। অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও চাচ্ছে যেকোনোভাবে কোম্পানিটকে বাঁচাতে হবে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আহসানুল করিম জানিয়েছিলেন, কোম্পানিটির অবসায়নে একটি পিটিশন ছিলো হাইকোর্টে। হাইকোর্ট গত ১৯ জানুয়ারি একটি অর্ডার দিয়েছিলেন। সেখানে বেশ কিছু ডিরেকশন ছিলো। এ কোম্পানির যে চেয়ারম্যান আছে তাকে অপসারণ করে সেখানে ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দেওয়া হলো। কোম্পানির ডিরেক্টরসহ কর্মকর্তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ হবে। তাদের পাসপোর্টগুলো সিজ হবে। এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং আপিল বিভাগে আবেদন করে। হাইকোর্টে যে মামলা করেছিলো এরইমধ্যে তার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আজকে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ আদেশ দিয়েছেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের নিচে নয় এমন একজন কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে বক্তব্য প্রদান এবং কোর্টে তাকে হাজির হতে হবে। একইসঙ্গে আদালতের নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদকেও লিখিত বক্তব্য দিতে এবং আসতে বলা হয়েছে ২৫ ফেব্রুয়ারি।

ওই কোম্পানির আমানতকারীদের আবেদনের পর ১৯ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক আদেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিকখাতের কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড পরিচালনার জন্য স্বাধীন পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়োগ দেন। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান, এমডি, বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারসহ (পিকে হালদার) ১৩ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করতে বলা হয়। এছাড়া প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের মা, স্ত্রী, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার, দুই কাজিন অমিতাভ অধিকারী ও অভিজিৎ অধিকারী, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এরফানউদ্দিন আহমেদ এবং বন্ধু উজ্জল কুমার নন্দীর ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ২০ জনের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন।

হাইকোর্ট যাদের সম্পদ, ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ করা এবং বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তারা হলেন- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম নুরুল আলম, পরিচালক জহিরুল আলম, নাসিম আনোয়ার, বাসুদেব ব্যানার্জি, পাপিয়া ব্যানার্জি, মোমতাজ বেগম, নওশেরুল ইসলাম, আনোয়ারুল কবির, প্রকৌশলী নুরুজ্জামান, আবুল হাসেম, মো. রাশেদুল হক, পি কে হালদার, তার মা লীলাবতী হালদার, স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, ভাই প্রিতুষ কুমার হালদার, কাজিন অমিতাভ অধিকারী ও অভিজিৎ অধিকারী, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরফানউদ্দিন আহমেদ এবং পি কে হালদারের বন্ধু উজ্জল কুমার নন্দী।

প্রশান্ত কুমার হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০
ইএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।