ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন

তোফাজ্জল লিটন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৭ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১০

রাজশাহীর শহরের অদূরে মতিহার থানার এক সবুজ ভূগোলে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পদ্মার পাড়ে  ১৯৫৩ সালে প্রায় ৩০৪ হেক্টর জমির ওপর পরিকল্পিত ও সুন্দর এই ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হয়।

এর পরিচিতি নানা কারণেই। তবে দেশের সবচেয়ে সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের ক্যাম্পাস যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, তা অনেকেরই অজানা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্তমানে ২১টি সক্রিয় সাংস্কৃতিক দল রয়েছে। সংগঠনগুলো চলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন, তাই শিক্ষাজীবন শেষে স্বাভাবিক নিয়মে বিদায় নিতে হয় সংগঠন থেকেও। এমনিভাবে যোগ-বিয়োগের ধারায় দাঁড়িয়ে থাকে দলগুলো। কেমন চলছে এসব সংগঠন, কী কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারাÑ জানা যাক অল্প কথায় :

স্বনন
স্বনন বাংলাদেশের প্রাচীনতম আবৃত্তি সংগঠন। বিভিন্ন দিবসে এবং নিয়মিতভাবে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান আয়োজন করে স্বনন। এছাড়া প্রতি বছর উদযাপন করে উৎসবমুখর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গত এপ্রিলে হয়ে গেল দলটির ৩০ বছর পূর্তি উৎসব। বছরে দু বার অডিশনের মাধ্যমে কর্মী নেয় স্বনন। প্রতিদিন বিকেলে মমতাজউদ্দিন কলাভবনের পূর্বদিকের বারান্দায় আবৃত্তির মহড়া করেন তারা।

অনুশীলন নাট্যদল
অনুশীলন নাট্যদল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ৮ অক্টোবর। তাদের মূলমন্ত্র : ‘নাট্য আন্দোলন সমাজ পরিবর্তন আন্দোলনের একটি অংশ’। দলটির নেতৃত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সভাপতি নাট্যকার মলয় ভৌমিক। সারা দেশে তাদের ৫০টি প্রযোজনার ৫২০টি প্রদর্শনী হয়েছে। ভূমিকন্যা, বিরসাকাব্য, চৌরাস্তা, বহে প্রান্তজন, দায়দায়িত্ব অনুশীলনের উল্লেখযোগ্য নাটক। বর্তমানে মহড়া চলছে তাদের ৫০তম প্রযোজনা ভূমিকন্যার।

সমকাল নাট্যচক্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রাচীন সংগঠন ‘সমকাল নাট্যচক্র’। দলটির যাত্রা শুরু ১৯৮১ সালের ২৫ নভেম্বর। বর্তমানে রাকসু ভবনের সবচেয়ে বড় কক্ষে স্বল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে কাজ করলেও দলের মোট নাটক ৫০টি। আর প্রদর্শনী হয়েছে ৪৮০ বার। কবি, মহাবিদ্যা, দড়ির খেলা, নবান্ন সমকালের উল্লেখযোগ্য নাটক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ড্রামা অ্যাসোসিয়েশন (রুডা)
১৯৮৩ সালের ৬ জুন প্রতিষ্ঠিত হয় রুডা। তারপর থেকে নিয়মিত কাজ করে আসছে। এ পর্যন্ত ৪৮টি নাটকের ৪০০ প্রদর্শনী হয়েছে। রুডার সভাপতি সাদেকুল আরেফীন মাতিন বলেন, মাঝেমধ্যে সব দলের মতো আমাদেরও কর্মীসংকটে পড়তে হয়, যেমন এখন আমাদের কর্মীসংকট চলছে। তাই নিয়মিত মহড়া আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। ১৯৭১, পান্তা আকালী, বিচ্ছু, গিরগিটি, গাধা, উভচর রুডার উল্লেখযোগ্য নাটক।

তীর্থক নাটক
পথনাটকের দল হিসেবে খ্যাত ‘তীর্থক নাটক’ ১৮ বছর ধরে পথনাটক করে আসছে। প্রথমবারের মতো এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তারা  একক মঞ্চনাটক মঞ্চায়ন করে। তাদের মোট নাটক ১৮টি। আদাব, লালসবুজ, রিসার্চ এ দলের অন্যতম নাটক।

বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার
১৯৯০ সালের ৩ জুন ‘জীবনের জন্য শিল্প’ এ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার। এ দলের ২৬টি  প্রযোজনার ৩৮০টি প্রদর্শনী হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে। তাদের চলমান প্রযোজনা পাইতাল। দলের উল্লেখযোগ্য নাটক চিলেকোঠা, রথের রশি, ক্বাহার, গরল ও ঠ্যারো।

বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা
‘বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা’ রাবি শাখা গানের পাশাপাশি নাটকও করে। গণসঙ্গীতের জন্যই তারা বিখ্যাত। লাশ এ দলের একটি উল্লেখযোগ্য নাটক। স্টেডিয়াম মার্কেটের সিঁড়ি নিচের একটি রুমে কাজ করে দলটি।

অ্যাসোসিয়েশন ফর কালচার অ্যান্ড এডুকেশন (এস্)
২০০০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা পায় অ্যাসোসিয়েশন ফর কালচার অ্যান্ড এডুকেশন (এস্)। মমতাজউদ্দীন কলাভবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা এ দলটির শিক্ষা বিভাগ স্পোকেন ইংলিশ, কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করে। সংস্কৃতি বিভাগে নাটক ,আবৃত্তি ও গণসঙ্গীত করে। মোট নাটক ২৫টি। এর মধ্যে তাসের দেশ রাবির প্রথম গীতিনাট্য।   উল্লেখযোগ্য নাটক সুড়ঙ্গ, একবচন বহুবচন ও কালের পাথর।

বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ নাটক, গান ও আবৃত্তিচর্চা করে। যদিও দলটি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, তবু অন্য দলের মতোই সাংস্কৃতিক কার্যক্রম করে। ক্ষেপা পাগলার প্যাঁচাল, জনৈক ইমান আলী, চান মিয়ার বায়োস্কোপ উল্লেখযোগ্য নাটক।

উদীচী
কলাভবনের নিচতলায়  কাজ করে ‘উদীচী’ রাবি শাখা। নাচ, গান ও নাটক এ তিন মাধ্যমেই উদীচী সক্রিয়। ২০০৯ সালে  তাদের একটি নাটক মান্দার মঞ্চায়নের ফলে জামায়াত-শিবির ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল করে এবং উদীচীর কর্মীদের হত্যার  হুমকি দেয়।

ঐকতান
মূলত নাটকের সংগঠন, বর্তমানে গানের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে মাঝে মাঝে। উল্লেখযোগ্য নাটক কঞ্জুস।

বিবর্তন                                                                                               
রাবি মার্কেটিং বিভাগের সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিবর্তন’। তারা বিভিন্ন দিবসে কনসার্টের আয়োজন করে। তাদের সহায়তা করে ক্যাম্পাসের ব্যান্ডসঙ্গীত দল অরণী ও সমগীত। অধ্যাপক তাহের হত্যার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসের সবচে বড় মানববন্ধনটি করে বিবর্তন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট
এসবের বাইরে বরেণ্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ২০০৫ সালে প্রগতিশীল এবং সক্রিয় ১১টি সংগঠন নিয়ে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট’ গঠন করেন। সংগঠনটি দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, উৎসব আয়োজন করে এবং বিভিন্ন দিবস পালন করে।

বিকল্প
ছাত্রশিবিরের অঙ্গ সংগঠন ‘বিকল্প’। তারা ইসলামি নাটক ও গানের আয়োজন করে। কাঁঠাল তাদের একটি উল্লেখযোগ্য নাটক।

রাবিতে মূলত আবৃত্তির্চচা ‘স্বনন’ই করে। তাছাড়া সমাজকর্ম বিভাগের ‘হসন্ত’ এবং বাংলা বিভাগের ‘চিহ্ন’, ‘কাহ্নপা’ ও ‘ধ্রুব’ নামে তিনটি সংগঠন সাহিত্যর্চচার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতা পড়ে। এর বাইরে  ইসমাঈল হোসেন শিরাজী ভবনে কাজ করে ‘নাট্য দুয়ার’ এবং ‘লালন চর্চা কেন্দ্র’।

এছাড়া আছে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা এবং উপজেলাভিত্তিক সংগঠন, যা তাদের আঞ্চলিক পরিচয় বহন করে। এসব সংগঠনের পক্ষ থেকেও নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘আমরা সাধারণত নবীন বরণ, প্রবীণ বিদায়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি। ’ জানালেন এমন একটি সংগঠন ‘সিলেট বিভাগীয় ছাত্র কল্যাণ সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ডিল্স।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সংগঠনকে সহায়তার জন্য আছে ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (টিএসসিসি)। কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন, শহীদ মিনার মুক্তমঞ্চসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান বরাদ্দ দেওয়ার কাজটি করে টিএসসি।

নাটকের মানের কথা বলতে গিয়ে টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এবং বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. সুজিত সরকার বলেন, ‘দলগুলোর অনুষ্ঠানের মান ভালো। তবে তা সবসময় বজায় থাকে না। এর কারণ দলগুলো সব ছাত্র-ছাত্রী নির্ভর। আর নাটক বা অনুষ্ঠানের মান নির্ভর করে অভিজ্ঞতার ওপর। কিন্তু যখন ছাত্রছাত্রীরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকে, তখনই তাদের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ক্যাম্পাস থেকে  বিদায় নিতে হয়। ফলে সমস্যা থেকেই যায়। ’

‘দলগুলো সাধারণত দেশের খ্যাতনামা নাট্যকারদের নাটকই মঞ্চায়ন করে। তবে অনুশীলন নাট্যদল, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার, তীর্থক নাটক, এস্-এর বেশির ভাগ নাটক নিজেদেরই’Ñ জানালেন টিএসসির নাট্যপ্রশিক্ষক আহসানুল কবির লিটন।

‘মনপুরা’র পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিমের নাম অনেকেরই জানা। তবে তিনি যে রাবির ‘বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারের’ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তা অনেকেরই অজানা। নাট্যকার-পরিচালক হাবিবুর রহমান হাবিব ছিলেন একই দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। অভিনেতা আরমান পারভেজ মুরাদও ছিলেন এই দলের সদস্য।

নাট্যকার মাসুম রেজা এবং নাট্যনির্দেশক সামসুল আলম বকুল ছিলেন অনুশীলন নাট্যদলের। অভিনেতা শামস সুমন ছিলেন স্বননের সদস্য।
রাবির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল নিয়মিত অংশগ্রহণ করে জাতীয় ও বিভাগীয় বিভিন্ন উৎসবে। এর মধ্যে সক্রিয় স্বনন, অনুশীলন নাট্যদল, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার, সমকাল নাট্যচক্র ও রুডা।

বাংলাদেশের স্থানীয় সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১০
এসকেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।