ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

চলচ্চিত্রকর্মী বাদল রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ও সতীর্থদের স্মৃতিতর্পণ

বিনোদন ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৫ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০১০

বাদল রহমান নিজেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা বলতেন না, চলচ্চিত্রকর্মী বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। এক বুক অভিমান নিয়ে এই সহজ-সরল নিরহঙ্কারী মানুষটি ১১ জুন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

অপূর্ণ রয়ে গেলো তার কিছু পরিকল্পনা কিছু স্বপ্ন।

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পথিকৃৎ মেধাবী চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ৪ জুন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকা-সক্রিয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। স্বাধীনতার পর সহকারী প্রযোজক হিসেবে যুক্ত হন বিটিভিতে। কিন্তু চাকরির ধরাবাঁধা নিয়ম তাঁর পছন্দ হলো না। ১৯৭৭ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে চলে যান ভারতে। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। কৃতিত্বের সঙ্গে সেখান থেকে ফিল্ম এডিটিংয়ের ওপর ডিপ্লোমা করে দেশে ফেরেন। প্রথমে কিছুদিন মূলধারার চলচ্চিত্রে সম্পাদনার কাজ করেছেন। ১৯৭৯ সালে নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দেন। বেছে নেন চলচ্চিত্রের এমন একটি শাখা, বাংলাদেশে তার আগে কেউ ও পথে হাঁটেননি। তৈরি করলেন বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ ছবি এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী। ছবিটি ১৯৮০ সালে ৫টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। পরে বাদল রহমান বেশ কিছু ডকুমেন্টারি ও শর্ট ফিল্ম তৈরি করলেও কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করেননি। তার ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে জানা যায়, যে ধরনের ছবি বানাতে চান তার পৃষ্ঠপোষক খুঁজে না পাওয়ায় খানিকটা হতাশায় ভুগছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন এক ধরনের অভিমান তার মধ্যে কাজ করেছে। বাদল রহমান সর্বশেষ শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক উপন্যাসটির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন। ইচ্ছে ছিল আগামী বছর নাগাদ ছবির কাজ শুরু করার। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধুর শৈশব নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। বাদল রহমান পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সবুজ পাতা, শিল্পী ও সূর্য, ছানা ও মুক্তিযোদ্ধা। চলচ্চিত্রের ভাষা নামে তার লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমী থেকে।

সুস্থ ছবি দেখা ও দেখানোর জন্য বাংলাদেশে সংঘটিত চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনকে শুরু থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন বাদল রহমান। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি পালন করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব। বাংলাদেশে প্রথম ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সের পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের দায়িত্বও তিনি পালন করেন। ফিল্ম সেন্সর কমিটির সদস্য হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পক্ষে থেকেছে তাঁর অবস্থান। তাই মূলধারার নির্মাতাদের কাছেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র।
গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগঠক বাদল রহমানের স্মৃতির প্রতি রইলো আমাদের বিনত শ্রদ্ধা।

সতীর্থদের কথা

বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি
রামেন্দু মজুমদার
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে কাজ করার সুবাদে বাদল রহমানের সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বড় মনের মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের দিকে কখনো তিনি তাকাননি, অন্যের জন্যই জীবনভর করে গেছেন। কারো কোন বিপদের কথা শুনলে সেটাকে নিজের বিপদ মনে করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। আন্দোলনে সংগ্রামে সবসময় তাকে দেখা যেত মিছিলের অগ্রভাগে। খুবই কর্মঠ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বাদল রহমান।

এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী বানিয়েই প্রমাণ করেছেন নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা
মামুনুর রশীদ
 বাদল রহমান চিন্তা-চেতনায় ছিলেন সময়ের চেয়ে অগ্রসর। বাংলাদেশে তিনিই ছিলেন চলচ্চিত্রে একাডেমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এক এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী বানিয়েই প্রমাণ করেছেন নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা। তাঁর কাছ থেকে উঁচুমানের আর কোনো ছবি পাইনি, এই ব্যর্থতা বাদল রহমানের না। এই ব্যর্থতার দায় আমাদেরই নিতে হবে। আমরা তাকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। শুনেছি, সংশপ্তক উপন্যাসটির চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা করার জন্য পৃষ্ঠপোষক পাচ্ছিলেন না। এটা একজন সুস্থধারার নির্মাতার জন্য খুব বেদনাদায়ক ।

তিনি মনে করতেন ভালো ছবি তৈরির আগে ভালো দর্শক তৈরি করা প্রয়োজন
সারা যাকের
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পেছনে বাদল রহমান যতটুকু সময় দিয়েছেন তা যদি চলচ্চিত্র পরিচালনার পেছনে দিতেন তাহলে আজ বাংলাদেশের সর্বাধিক ছবির নির্মাতা থাকতেন তিনি। বাদল রহমান মনে করতেন ভালো ছবি তৈরির আগে ভালো দর্শক তৈরি করা প্রয়োজন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের মূল কথাই হলো, ভালো ছবি দেখা ও দেখানো। সেদিকে জোর দিতে গিয়ে এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী-র পর নতুন কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করতে পারেননি। আমি মনে করি এক এমিলের গোয়েন্দাবাহিনীই তাকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখবে।

মূলধারার চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়েছেন সব সময়
আমজাদ হোসেন
 এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী দেখার পর আমি বাদল রহমানকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ছাড়া তাঁর কাছ থেকে আমরা পূর্ণদৈর্ঘ্য কোনো ফিল্ম পাইনি। কেন তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করলেন না, সেটা আমার কাছে একটা বড় রহস্য। তিনি মৃত্যুর আগে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন। মূলধারার চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের প্রতি সেখানে তিনি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়েছেন সব সময়।

চলচ্চিত্রবোদ্ধা বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই
চাষী নজরুল ইসলাম
আমাদের চলচ্চিত্র জগতে বাদল রহমান ছিলেন শিক্ষিত ও মেধাবী নির্র্মাতা। চলচ্চিত্রবোদ্ধা বলতে যা বোঝায় বাদল রহমান ছিলেন তাই। চলচ্চিত্র বিষয়ে তার পড়াশোনা সীমাহীন, আমরা তার কাছ থেকে অনেক রেফারেন্স পেয়েছি নানা সময়। তিনি মুখে যা বলতেন, অন্তর দিয়ে তাই বিশ্বাস করতেন। ভালো ছবি দেখার দর্শক তৈরি না হলে ভালো ছবি বানানো বৃথা বলে মনে করতেন। তাই ভালো ছবির দর্শক তৈরির জন্য সংগঠিত করেছিলেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন।

গ্রন্থনা : বিপুল হাসান

বাংলাদেশ স্থানীয় ১১১০, ০১ জুলাই ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।