নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন বাংলানাটকে যুক্ত করে গেছেন স্বকীয়ধারা। পশ্চিমা নাট্য-আঙ্গিককে অস্বীকার করে হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্য নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।
সেলিম আল দীন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির। চঞ্চলতায় যেমন সমবয়সীদের মধ্যে ছিলেন সেরা, পড়ালেখাতেও ছিলেন সবার সেরা। ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামের পাঠ চুকিয়ে বাবার চাকরিসূত্রে কখনও যেতে হত চট্টগ্রামে, কখনও সিলেট, কখনও আখাউড়া, কখনও রংপুরে। তারপর আবার ফিরে যান নিজ গ্রামে। সেখানে মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন।
স্কুলজীবনেই সেলিম আল দীনের পড়া হয়ে যায় বাংলাসাহিত্যের প্রধান প্রধান কবি-সাহিত্যিকদের রচনা। এভাবে একটু একটু করে তৈরি হতে থাকে একজন শিল্পীর সৃজনশীল মনন। কলেজে ওঠার সময়টায় বুঝতে পারেন কবিতা তাকে ডাকছে। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে বিমুগ্ধ তরুণ সেলিম আল দীন কবিতার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করতে চাইলেন প্রথমে। কিন্তু কিছুতেই কবিতার ভাষাটি আয়ত্তে আসছিল না তার। এই বেদনা তাকে তাড়িয়ে ফেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময়েও। সাহিত্যের কোন শাখাকে পথচলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেবেন, এই টানাপোড়েনের মধ্যেই তার নাটক লেখা শুরু।
সহপাঠী বন্ধুদের চাপে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার জন্য প্রথম নাটক লেখেন। নাটকই হয়ে ওঠে তার পথ চলার প্রধান বাহন।
১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর নাটক লেখার ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সেলিম আল দীন নিজস্ব এক নাট্যরীতির অনুসন্ধান চালিয়ে যান। প্রসেনিয়ামের গন্ডিতে বাঁধা ইউরোপিয়ন নাট্য-আঙ্গিককে তিনি পরিত্যাগ করেন। খুঁজে বের করলেন বাংলা নাটকের হাজার বছরের পুরনো শিল্পরীতিকে। এ নাট্যরীতি আমাদের একেবারেই নিজস্ব। ছোটগল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মতো পাশ্চাত্যের প্রেরণাতাড়িত বিষয় নয়। লুঙ্গিনুসের ‘অন সাবলাইম’ আর পিটার ব্র“কের ‘দ্য এম্পটি স্পেস’-এর মতো তত্ত্বগুলোর সঙ্গে তিনি সমন্বয় করতে চাইলেন প্রাচ্যের নান্দনিকতার। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের নির্যাস ও বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সাহিত্যরীতি থেকে পাওয়া শিল্প উদ্দীপনাগুলো, এমনকি শব্দপ্রতিমাকে নতুন করে জাগিয়ে তুললেন নিজের সৃষ্টিকর্মে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর সেলিম আল দীনের উদ্যোগেই ১৯৮৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগ। একদিকে শিকতার দায়িত্ব, অন্যদিকে লেখালেখি। পাশাপাশি চালিয়ে যান আবহমান বাংলার লোকজরীতির অনুসন্ধান। গ্রাম থিয়েটারের হয়ে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছুটেছেন লোক-নাট্যরীতির সন্ধানে। নিজের নাটকে সেসব প্রয়োগ করে বদলে দেন বাংলানাট্যের ধারা। আশির দশকের মাঝমাঝি সময় থেকে তিনি গান লেখা শুরু করেন। নাটকের গান তো ছিলই। পাশাপাশি আরও অনেক গান লিখেছিলেন। তিনি গানকে বলতেন, কথাসুর। টিভির জন্যও তিনি লিখেছেন বহু নাটক। সেলিম আল দীনের লেখা ‘কীর্তনখোলা’ ও ‘চাকা’ নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে চলচ্চিত্র।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে যেই মানুষ অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন সেলিম আল দীন। বিভিন্ন উৎসবের মূল বাণী ঠিক করে দেওয়া, অনুষ্ঠানের আমেজ অনুযায়ী গান তৈরি করে দেওয়া সবই করতেন। সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মাটিতেই অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে আছেন। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি বাংলা নাটকের অবিসংবাদিত পুরুষ সেলিম আল দীন অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় যেদিন তিনি মারা যান, দেশের পুরো সংস্কৃতি অঙ্গন সেদিন শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়।
নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের সংপ্তি জীবনী
জন্ম ও শৈশব
নাট্যকার সেলিম আল দীন জন্মেছিলেন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে। তার পিতার নাম মফিজউদ্দিন আহমেদ ও মাতার নাম ফিরোজা খাতুন।
শিক্ষা
প্রথম লেখাপড়ার শুরু আখাউড়ায় গৃহশিকের কাছে। কিছুদিন পর সেনেরখিল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। তারপর মৌলভীবাজার বড়লেখার সিংহগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রামের উলিপুরে মহারাণী স্বর্ণময়ী প্রাইমারী স্কুল এবং রংপুর ও লালমনিরহাটের স্কুলে পড়েন। পরে নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৪ সালে। ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। টাঙ্গাইলের সাদত কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
পেশা
বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপিতে কপি রাইটার হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করলেও পরে সারাজীবন শিকতাই করেছেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।
উল্লেখযোগ্য নাটক
‘সর্পবিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক’ (১৯৭৩), ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ (১৯৭৫), ‘বাসন’ (১৯৮৫) ‘মুনতাসির’, ‘শকুন্তলা’, ‘কিত্তনখোলা’ (১৯৮৬), ‘কেরামতমঙ্গল’ (১৯৮৮), ‘যৈবতী কন্যার মন’ (১৯৯৩), ‘চাকা’ (১৯৯১), ‘হরগজ’ (১৯৯২), ‘প্রাচ্য’ (২০০০), ‘হাতহদাই’ (১৯৯৭), ‘নিমজ্জন’ (২০০২), ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ (২০০৭), ‘পুত্র’, ‘স্বপ্ন রমণীগণ’ ও ‘ঊষা উৎসব’।
রেডিও-টেলিভিশন নাটক
‘বিপরীত তমসায়’ (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯), ‘ঘুম নেই’ (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০), ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), ‘অশ্রুত গান্ধার’ (বিটিভি, ১৯৭৫), ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ (বিটিভি ১৯৭৭), ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ (আয়না সিরিজ, বিটিভি ১৯৮২-৮৩), ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ (বিটিভি ১৯৯০-৯১), ‘ছায়া শিকারী’ (বিটিভি ১৯৯৪-৯৫), ‘রঙের মানুষ’ (এনটিভি ২০০০-২০০৩), ‘নকশীপাড়ের মানুষেরা’ (এনটিভি, ২০০০), ‘কীত্তনখোলা’ (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)।
গবেষণাধর্মী নির্দেশনা
‘মহুয়া’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০), ‘দেওয়ানা মদিনা’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২), ‘একটি মারমা রুপকথা’ (১৯৯৩), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘মেঘনাদ বধ’ (অভিষেক নামপর্ব)।
অন্যান্য
‘চাকা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪ সালে এবং ‘কীত্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে। ‘একাত্তরের যীশু’ চলচিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে।
জাতীয়-আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৪; ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা, ১৯৮৫; কথক সাহিত্য পুরস্কার, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ; একুশে পদক, ২০০৭; জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, ১৯৯৩; অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা); নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা) ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার, ১৯৯৪; খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার; জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪; মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, ২০০৫।
সেলিম আল দীন স্মরণে তিন দিনের অনুষ্ঠান
সেলিম আল দীনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটার এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী যৌথভাবে আয়োজন করেছে তিন দিনব্যাপী ‘সেলিম আল দীন স্মরণ অনুষ্ঠান’। এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারী সহযোগী সংগঠন হিসেবে রয়েছে স্বপ্নদল ও দ্যাশবাংলা থিয়েটার।
অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ১৪ জানুয়ারি শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে রয়েছে স্মরণ শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি পুরাতন কলাভবন থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করবে। সাড়ে ১০টায় সেলিম আল দীনের কবরে পুস্পার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। ঢাকার জাতীয় শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গণে বিকাল ৫টায় অনুষ্ঠিত হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধন করবেন ড. মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম। সন্ধ্যা ৭টায় মূল মিলনায়তনে প্রদর্শিত হবে নাটক ‘ধাবমান’, পরিবেশনায় থাকছে ঢাকা থিয়েটার। সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় শিল্পকলা একাডেমীর পরীণ হলে প্রর্দশিত হবে নাটক ‘প্রাচ্য’, পরিবেশন করবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ।
দ্বিতীয় দিন ১৫ জানুয়ারি শনিবার বিকাল ৩টায় জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার হলে রয়েছে সেলিম আল দীনের নাটকে সংলাপ ও সঙ্গীতের দ্বৈতাদ্বৈতবাদিতা বিষয়ক সেমিনার। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ আলোচনা করবেন মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। সাড়ে ৫টায় শিল্পকলা একাডেমীর পরীণ হলে প্রদর্শিত হবে নাটক ‘ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি’। পরিবেশনায় থাকছে স্বপ্নদল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দ্যাশবাংলা থিয়েটার পরিবেশনায় শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও হলে প্রদর্শিত হবে নাটক ‘জুলান’।
তৃতীয় দিন ১৬ জানুয়ারি রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও হলে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের পরিশেনায় রয়েছে ‘সেলিম আল দীনের দিনলিপি থেকে পাঠ’। সন্ধা সাতটায় শিল্পকলা একাডেমীর পরীণ হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের পরিবেশনায় প্রদর্শিত হবে নাটক ‘কেরামতমঙ্গল’ এবং সাড়ে সাতটায় শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও হলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পরিবেশনায় প্রদর্শিত হবে নাটক ‘পুত্র’।
এছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেলিম আল দীন রচিত এবং জনপ্রিয় শিল্পী ফাহমিদা নবী পরিবেশিত সঙ্গীত অ্যালবাম ‘আকাশ ও সমুদ্র অপার’-এর মোড়ক উন্মোচন করা হবে। মোড়ক উন্মোচন করবেন প্রয়াত নাট্যাচার্যের পতœী বেগমজাদী মেহেরুনন্নেসা।
বাংলাদেশ সময় ০০১৫, জানুয়ারি ১৪, ২০১০