ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

ভাষার জন্য প্রাণের গান

বিপুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১১

‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি... তোরা ঢাকার শহর রক্ত ভাসাইলি’ এই গানটি শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের কণ্ঠে শুনে লাখো মানুষের অন্তর হয়েছে বিষাদময়। একুশে ফেব্রুয়ারি আর ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে এমনি অনেক হৃদয়ছোঁয়া গান বাঁধা হয়েছে।

কেউ গান লিখেছেন, কেউ সুর করেছেন আর কেউবা তাতে কণ্ঠ দিয়েছেন। এইসব গুণী মানুষের বেশিরভাগই চিরবিদায় নিয়েছেন, কেউ কেউ বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ভাষার মাসে সেইসব গুণীজনকে বিনত শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলানিউজের এই বিশেষ রচনা।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

জাতীয় সঙ্গীতের পরেই যে গানটি গভীর মমতায় গাওয়া হয়, তা হলো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।   একুশের প্রভাতফেরির এই গানটির গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কবিতা হিসেবে এটি তিনি লিখেছিলেন। এতে প্রথম সুরারোপ করেন প্রয়াত গণসঙ্গীত শিল্পী আবদুল লতিফ। পরে গানটিতে নতুন সুর দেন আলতাফ মাহমুদ। তার দেওয়া সুরেই বর্তমানে একুশের গানটি গাওয়া হচ্ছে।

একুশের এই গানটি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী  লিখেছিলেন পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। মূল কবিতাটি ছিল অনেক লম্বা। সেখান থেকে প্রথম কয়েকটি চরণ নিয়ে ১৯৫৩ সালে গানটি সুর করে প্রথমবার ঢাকা কলেজের ছাত্রদের এক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেন আবদুল লতিফ। এ ধরনের একটি গান পরিবেশন করায় কর্তৃপক্ষ ুব্ধ হয় এবং অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১১ ছাত্রকে তারা বহিষ্কার করে। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ গানটি নতুন করে সুর দেন।

একুশে নিয়ে প্রথম গান

একুশে ফেব্রুয়ারির বেদনাদায়ক ঘটনা নিয়ে প্রথম গান রচনা করেছিলেন প্রয়াত ভাষাসৈনিক গাজীউল হক। ১৯৫২ সালের যে ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তার সভাপতি ছিলেন গাজীউল হক। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পুরান ঢাকার আর্মানিটোলা মাঠে এক জনসভায় গাজীউল হক নিজেই এই গানটি গেয়ে শোনান।

গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন এরকম ‘ ভুলবো না ভুলবো না এ একুশে ফেব্রুয়ারি, ভুলবো না/লাঠি, গুলি আর টিয়ার গ্যাস, মিলিটারি আর মিলিটারি/ ভুলবো না’। গানটি ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত প্রভাতফেরিতে গাওয়া হতো বলে জানা যায়।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি

মাটিঘেঁষা সুর নিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি’ গানটি ভাষা আন্দোলনের আরেকটি স্মরণীয় গীতিকবিতা। শামসুদ্দীন আহমেদ রচিত এই গানটির সুর করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ষাটের দশকে গানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে এই গান। এখনো একুশ এলে গানটি গাওয়া হয় সর্বত্র। একে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ে রয়েছে বিশেষ অবদান।

দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে দেশে ফিরেছেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ গানটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি যেখানেই গাইতে গেছি বার বার অনুরোধ এসেছে গানটি গাওয়ার জন্য। খুব অল্প বয়স থেকে গানটির সঙ্গে আমার পরিচয়। সুরকার আলতাফ মাহমুদ আমাকে পাশে বসিয়ে গানটি শিখিয়েছেন। একাত্তরে সপরিবারে আমাদের কলকাতায় আশ্রয় নিতে হয়। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমার কণ্ঠে গানটি প্রচার করা হতো। কয়েক যুগ কেটে গেছে, তবু আজও কত প্রাণ ও  শক্তি রয়ে গেছে এ গানটিতে। আমি জানি, সবার মতো একদিন আামাকে চলে যেতে হবে। তবে আমার বিশ্বাস, এ গানটি বেঁচে থাকবে আজীবন।

আমার ভাই আলতাফ মাহমুদ : শিমূল ইউসুফ

মুক্তিযুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ আলতাফ মাহমুদের প্রধান পরিচয় ছিল, তিনি একজন গণসঙ্গীত শিল্পী। একাধারে ছিলেন গায়ক, সুরকার ও সংগঠক। তিনি অমর হয়েছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সুর করে। একুশের একাধিক গান সুর করে গেছেন এই গুণীজন। যার মধ্যে রয়েছে ‘আমার কণ্ঠ রুদ্ধ করেছে যারা/তাদের কি শেষ নেই’, ‘নতুন দিনের জয়/ মায়েদের বোনেদের শিশুদের অশ্রু মুছবোই’।

আলতাফ মাহমুদ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে তার বোন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ বললেন, তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গান ছিল তার আত্মার খোরাক। গান গাওয়া আর সুর করা ছাড়াও তিনি ছবি আঁকতেন। গণসঙ্গীত ছিল শহীদ আলতাফ মাহমুদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। কোনো নতুন গানে সুর হলে আমাদের ডেকে নিয়ে শোনাতেন। যদিও তাকে আমরা খুব কমই বাসায় পেয়েছি। বাইরে বাইরে থাকতেই তিনি পছন্দ করতেন। আমার বয়স সে সময় খুব কম। তবু ভাইয়ের দরাজ কণ্ঠের গান আমি আজও শুনতে পাই।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরে পাক-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক সংগ্রামী শিল্পী। অসহযোগ আন্দোলনে বিুব্ধ শিল্পীসমাজের মিছিলে তার কণ্ঠে ছিল সেøাগান, হাতে ফেস্টুন। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম লগ্নে পেট্রোল-বোমা বানানোর মাল-মসলা সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। অস্ত্র সংগ্রহেরও চেষ্টা করেছিলেন। যুক্ত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ক্র্যাকপ্ল্যাটুনের সঙ্গে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের জন্য তিনি উদ্দীপনামূলক দেশের গান রেকর্ড করে পাঠান। এর একটা অংশ স্বাধীন বাংলা বেতারে পৌঁছায়। অন্যটির বাহক ১২টি গানের স্পুলসহ ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট হানাদার বাহিনী তাকে রাজারবাগের নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে।

ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়

ভাষা আন্দোলনের গানে স্মরণীয় এক নাম আবদুল লতিফ। গণসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তার লেখা ভাষার গান ও দেশের গানের সংখ্যা প্রায় ২৪টি। নিজের লেখা গান তিনি নিজেই সুরারোপ করতেন। আবদুল লতিফের জনপ্রিয় গণসঙ্গীতের মধ্যে রয়েছে ‘মুখের কথা খাইতে গিয়া খাইছি বুকে গুলিরে’, ‘সেবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে বীজ হয়েছে বোনা’, ‘আমি যে রফিক-শফিক- সালাম-জব্বার-বরকতের ভাই  গর্ব করি তাই’ প্রভৃতি।

এই গুণী শিল্পী সম্পর্কে শিমূল ইউসুফ বলেন, একটা মানুষ কতোটা প্রাণবন্ত আর মানসিক শক্তির অধিকারী হতে পারেন তার প্রমাণ হতে পারেন আবদুল লতিফ। তাকে দেখেছি দিনভর গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে গান-বাজনা করছে। আবার সন্ধ্যায় দেখা যেত, বন্ধুদের আসরে তিনিই থাকতেন সবার মধ্যমণি।

আবদুল লতিফের অন্য সব গানের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়/ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়’ গানটি। অসাধারণ এই গানটি প্রতি ভাষা দিবসেই গাওয়া হয়। শিল্পী আবদুল লতিফ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৫ সালে। কিন্তু তার তৈরি করা গানই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ।

আরো যারা

ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে বিভিন্ন সময় আরো যারা গান লিখেছেন ও সুর করেছেন তাদের মধ্যে কবিয়াল রমেশ শীল, সত্যেন সেন, সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়।

বাংলাদেশ সময় ০০২০, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।