ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

অন্ধ চোখ কণ্ঠে সুর : আলোয় ভুবন ভরা ...

মুনিফ আম্মার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১১

ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে একতলা ঘর। সামনে খোলা বারান্দা।

একপাশে সাজানো একজোড়া তবলা। সাথে একটি হারমোনিয়াম। ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে সুর। মিষ্টি সুর মুগ্ধ করে দিল প্রথমেই। দরোজা ঠেলে ঢুকতেই দেখা মিললো ওদের। চারপাশে পাতানো চেয়ারে গোল হয়ে বসা সবাই। সংখ্যায় কুড়ির কোঠায়। এককোণে বসেছে রুবা আর টুংটাং। ওরা দু’বোন। এ দু’বোনকে ঘিরেই আবর্তিত অন্য এতগুলো প্রাণ।

বয়সে সবাই তরুণ। সবেমাত্র কিশোর পেরিয়েছে কেউ কেউ। তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা ওদের কাছে একটু ভিন্নরকম। সময়ে অসময়ে ঘুরে বেড়ানো আর রাতভর জেগে আড্ডা দেয়া নয়। সময়কে ওরা মাতিয়ে তোলে, মেতে ওঠে সময়ের তালে নিজের মত করে। গান, কবিতা, নাটক, একটু আধটু খেলাধুলা আর কম্পিউটারের সাথে ওরা তারুণ্যের উদ্দাম আনন্দকে বিলিয়ে দিয়েছে।

ওরা সবাই ইনার আইস মিউজিক ইনন্সিটিটিউশন ফর ব্লাইন্ডসের সদস্য। চোখে দেখে না কেউ। তবে মনের চোখে বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে বিভোর। মন দিয়ে তারা দেখে নেয় পৃথিবীর যত আলো। ওদের মনের আলো ছড়িয়ে পড়ে আলোর পৃথিবীতে।

ইনার আইস মিউজিক ইনন্সিটিউশন ফর ব্লাইন্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মাড্ডায় অবস্থিত। একজন আলোর মানুষের হাতে গড়ে ওঠা অনন্য প্রতিষ্ঠান। ওস্তাদ আফজালুর রহমান। তাঁর নিজের চোখেও আলো ছিল না। কিন্তু মনের আলোর প্রখরতা ছিল প্রচ- তীব্র। দৃষ্টিহীন হয়েও দৃষ্টিমানদের চেয়েও এগিয়ে ছিলেন শতক্রোশ বেশি। আর তাইতো আফজালুর রহমান দৃষ্টিহীনদের জন্য ১৯৮০ সালে গড়ে তুলেছেন এ প্রতিষ্ঠানটি। এখানে দৃষ্টিহীনরা তাদের আলো ছড়ানো শিখবে, বিকাশ ঘটাবে লুকিয়ে থাকা সব প্রতিভার, এমন স্বপ্নেই এ প্রতিষ্ঠানটি তিনি গড়ে তুলেছিলেন। ওস্তাদ আফজালুর রহমানের দু’মেয়েও দৃষ্টিহীন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েদের হাতেই এগিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।

অসম্ভব তারুণ্য ঢেউ খেলে যায় রুবা আর টুংটাংদের মাঝে। তারুণ্যের পাল তোলা এ নায়ে এখন একদল যাত্রী। গান, কবিতা আর বাদ্যযন্ত্র শিখেই ওদের সময় কেটে যায়। মজার ব্যাপার হলো, ওসব কিছু শিখাতে ওদের কোন দৃষ্টিমান শিক্ষক নেই। কম্পিউটারের মত যন্ত্রও ওরা সুনিপুনভাবে শিখে নেয় দৃষ্টিহীন শিক্ষকদের কাছ থেকে। অনাবিল আনন্দে ওরা শিখে নেয় সবকিছু।

রুবা আর টুংটাংয়ের বয়স পঁচিশের কোঠায়। হৃদয়ভরা স্বপ্ন ওদের। এ স্বপ্ন তারুণ্যের। এ স্বপ্ন দিয়ে ওরা গড়ে তুলতে চায় দৃষ্টিহীনদের জন্য পূর্নাঙ্গ এক প্রতিষ্ঠান। দৃষ্টিহীনদের যেন আর কোনদিন কেউ অক্ষম না বলতে না পারে, সেটাই প্রমাণ করতে চায় রুবা আর টুংটাং। কাঠখড় পুড়িয়ে এ স্বপ্নে তরুণ্যে ভরপুর এ দু’বোন হেঁটে যাচ্ছে অনবরত। সব বাধা জয় একদিন করার দীপ্তি ঝরে পড়লো ওদের কণ্ঠ থেকে। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘আমরা প্রমাণ করতে চাই, আমরা অক্ষম নই। কারো করুণার পাত্র হতে চাই না, অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবো। ’

বিশ্বখ্যাত স্যাটেলাইট চ্যানেল আল-জাজিরা টিভিও ইনার আইস মিউজিক ইনন্সিটিউট নিয়ে ক’বছর আগে নির্মান করে গেছে একটি প্রামাণ্য চিত্র। আধাঘন্টার এ প্রামাণ্য চিত্রটি বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষ। থেমে নেই রুবা’দের যাত্রা। এরই মধ্যে ওরা ঘুরে এসেছে জাপান থেকে। ওখানের একটি সেমিনারে জোর গলায় বলে এসেছে ‘দৃষ্টিহীনরা অক্ষম নয়, কখনো কখনো দৃষ্টিমানদের চেয়েও অধিক সক্ষম। ’

স্বপ্নভরা ইনার আইস মিউজিক ইনন্সিটিউট ফর ব্লাইন্ডসের সদস্যরা তারুণ্যের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিতে চায় অপুর্ণতা। স্বপ্ন দিয়ে সাজাতে চায় চারপাশের সবকিছু। চোখে আলো নেই, তাতে কি? মনে যে আলোর ঝলকানি নিত্য খেলা করে যায়, সে আলোয় একদিন ঠিকই ভূবন ভরিয়ে দিবে।

(মুনিফ আম্মার : সংবাদ পাঠক ও অনুষ্ঠান উপস্থাপক/ বাংলাদেশ বেতার)

বাংলাদেশ সময় ১৬১৫, আগস্ট ২৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।