ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

আফ্রিকা: ভিন্ন পৃথিবীর গল্প-১

মুনজুরুল করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৩
আফ্রিকা: ভিন্ন পৃথিবীর গল্প-১

মধ্য আফ্রিকার দেশ উগান্ডার এন্তেবি এয়ারপোর্ট থেকে কঙ্গোর বুনিয়ায় যাওয়ার জন্য ইউক্রেনের একটা হেলিকপ্টারে উঠলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের একটি পরিদর্শক দল।

১৮ নভেম্বর, সোমবার।

সাথে দৈনিক সমকালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন থেকে আমি আর ক্যামেরায় কাজী ঈসমাইল। আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল ভ্রমণের মাধ্যম প্লেন না হয়ে হেলিকপ্টার হওয়ায় এ যাত্রা কিছুটা বিরক্তিকর হবে এবং সময় বেশি লাগবে। ভাবছিলাম, আমার মতো মানুষেরা যাদের নিয়মিত হেলিকপ্টারে উঠতে হয় না তাদের কাছে ব্যাপারটা বিরক্তিকর না হয়ে রোমাঞ্চকরও তো হতে পারে। /albert42

যাই হোক হেলিকপ্টার আমাদের নিয়ে এন্তেবি থেকে উড়াল দিলো বুনিয়ার উদ্দেশ্যে। লেক ভিক্টোরিয়ার তীরের শহর এন্তেবির সৌন্দর্য বাংলাদেশ থেকে এখানে আসার সময়টাতেই দেখেছি আকাশ থেকে। তবুও আবার দেখি। আফ্রিকার প্রাণ লেক ভিক্টোরিয়া, তার পাশে পাহাড়ী শহর মনের মধ্যে সৌন্দর্যের একটা স্থায়ী ছবি তুলে রাখে। আসলে সুন্দর কখনো পুরনো হয় না। কিন্তু আমাদের হেলিকপ্টার দ্রুত গতিতে ওপরে উঠতে থাকে, এন্তেবি আর লেক ভিক্টোরিয়া আরো নিচে আর পেছনে ফেলে। সামনে এগিয়ে আসে আফ্রিকার বুনো সৌন্দর্য।

এবার মনে হলো এই হেলিকপ্টারে এসে সুবিধাই হয়েছে। কারণ, প্লেনের তো জানালা খোলার সুযোগ ছিল না কিন্তু আমরা হেলিকপ্টারের জানালা খুলতে পেরেছি। পাহাড়-পর্বতের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। জানালার একেবারে পাশ দিয়ে মেঘের দলেরা উড়ে যায়, হয়তো ভেতরেও ঢুকে যায় কোনো কোনোটা। এভাবে কতক্ষণ জানালা দিয়ে আফ্রিকার দুর্ভেদ্য সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। হয়তো ইচ্ছেও করিনি কখনো যে জানালা থেকে চোখ ফেরাবো।

হঠাৎ কে যেন বললো, নিচে তাকান নিচে তাকান! তাকালাম। সেই যে তাকালাম, বেশ অনেকক্ষণ আর চোখ ফেরাইনি। কারণ, চোখ ফেরানো যায় নি। দেখলাম, দীর্ঘ পাহাড়ের একটা সারি হঠাৎ করেই একটা জায়গায় এসে যেন থমকে দাঁড়িয়েছে, আর এগোয়নি। পাহাড়গুলোর ঠিক পায়ের কাছে শান্ত আর নীলাভ জলরাশি। শান্ত বলছি এ কারণে যে, যতটা ওপর থেকে দেখেছি সেখান থেকে জলরাশিতে ঢেউ ছিলো কি না বোঝার উপায় ছিলো না। আকাশ, পাহাড় আর জলরাশির একটা প্রেমময় সন্ধ্বি হয়েছে এখানে। মনে হচ্ছিল, পাহাড় তো আগেই থেমেছে আর এ জলরাশি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে আকাশ একটা নীলচে দেয়াল তুলেছে। আর মেঘগুলো যেন পাখি হয়ে উড়ছে এ স্বর্গে।

এ পথে যাওয়া পুরনো একজন বললেন, ‘লেক এ্যালবার্ট’। এই লেক আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। এর দুই তীরে দুই দেশ, উগান্ডা আর কঙ্গো। লেক এ্যালবার্টের দৈর্ঘ্য ১৬০ কিলোমিটার। আমরা ঠিক মাঝ বরাবর উড়ে গেছি। সেই মাঝখানটা ৩০ কিলোমিটার। আর সব মিলিয়ে এর আয়তন ৫৩০০ কিলোমিটার। সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২১০০ ফুট ওপরে এর অবস্থান। /albert3

চোখ আটকে থাকে লেক এ্যালবার্টের দিকে। কিন্তু হেলিকপ্টার আমাদের আবারো টেনে নিয়ে যায় পাহাড়ের দিকে। লেকের প্রস্থ ৩০ কিলোমিটার পার হতে বেশি সময় লাগেনি। এপারে দাঁড়িয়েছিল কঙ্গোর পাহাড়গুলো। আকাশ থেকে দেখলে পাহাড়গুলোর উচ্চতা বা একটির সাথে আরেকটির পার্থক্য বোঝা যায় না। কিন্তু অনুমান করতে পারি। যাই হোক, আরো বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা নির্দিষ্ট গন্তব্য বুনিয়াতে পৌঁছালাম এবং নানা ধরনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে দিন শেষ হলো। আমাদের জানিয়ে রাখা হয়েছে যে, পরের দিন আমরা বুনিয়া থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বোগোরো নামে একটা জায়গায় যাবো যেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল জাতিসংঘের হয়ে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত।

পরের দিন আমরা রওনা দিলাম বোগোরো’র উদ্দেশে। বুনিয়া সিটি থেকে বেরিয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগলো না। আবার পাহাড়ি এবড়ো-থেবড়ো পথে চলতে লাগলো আমাদের গাড়িবহর। আবার পাহাড়ী ধাঁধার মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করলাম আমরা। প্রকৃতি এখানে এতটাই উদার যে, কোন দিকে চোখ ফেরালেই হতাশ হতে হয় না। এমন দেশে তো সারা বছর পর্যটকের ভীড় লেগে থাকবে। কিন্তু বুনিয়া থেকে শুরু করে কোথাও এক ইঞ্চি রাস্তাও পাকা দেখিনি। সারা বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লেগে থাকে বিভিন্ন দলের মধ্যে। এসব পাহাড় খুঁড়লে বেরিয়ে আসে হীরা আর সোনা। কিন্তু এখানকার মানুষই হতদরিদ্র। এক গ্লাস পানি, এক প্যাকেট বিস্কুট বা এক বেলা খাবারের জন্য নিত্য হানাহনি আর হাহাকার এখানে। তাই শত আগ্রহ থাকলেও কোনো পর্যটকেরই মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর উপায় নেই এখানে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমরা পৌঁছালাম বোগোরো। বুঝতে পারিনি বোগোরো’র পথ আমাদের আবারো লেক এ্যালবার্টের কাছে নিয়ে এসেছে। হেলিকপ্টার থেকে দেখেছি কঙ্গোর পাহাড়ের পায়ের কাছ লেক এ্যালবার্ট, এবার দেখছি আমাদের পায়ের কাছে। আসলে হেলিকপ্টার থেকে যেসব পাহাড় দেখেছিলাম তারই কোন একটাতে এসে দাঁড়িয়েছি। খুব কাছে মনে হচ্ছে। কিন্তু জানা গেল, যেতে গেলে ২৫/২৬ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে।

১৮৬৪ সাল। স্যামুয়েল বেকার এবং স্যাস ফ্লোরা নামের দুজন অভিযাত্রীর চোখে ধরা পড়ে এই অসাধারণ লেকটি। প্রিন্স এ্যালবার্টের নামে এর নামকরণ করেন তারা। ২০ শতকে এসে কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট মবুতু সেসে সেকো নিজের নামে এই লেকের নাম রাখেন। পরবর্তীতে ইতিহাসের বহু ঝড়ঝাপ্টার সাক্ষীও হয়েছে এই লেক এ্যালবার্ট। ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যবাদীরা প্রথম জলযান নামায় এই লেকে। ব্রিটিশরা করেছিল আরো বড় পরিকল্পনা।  albert1

এই লেককে কেন্দ্র করেই তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এলাকা মিশর, পূর্ব আফ্রিকা এবং আফ্রিকার দক্ষিণ অংশের মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চেয়েছিল। এই উদ্দেশ্যেই ১৯৩০ সালে একটা পণ্য এবং যাত্রীবাহী জাহাজ তৈরি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইন্সটন চার্চিল সেই জাহাজকে বর্ণনা করেছিলেন ‘সেরা ভাসমান লাইব্রেরী’ হিসেবে আর নোবেল বিজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন ‘পানির ওপরের চমক’। আরো ৩৪ বছর পর, ১৯৬৪ সালের দিকে লেক এ্যালবার্টে ডুবে যায় জাহাজটি। শুধু আকাশ বা পাহাড় থেকে দেখা সৌন্দর্য নয়, আশপাশের মানুষের মাছের চাহিদার বড় অংশ পুরণ করে এই লেক। এখানেই শেষ নয়। ধারণা করা হচ্ছে, কমপক্ষে দুই বিলিয়ন ব্যারেল তেল মজুদ আছে এই এ্যালবার্টের আশপাশে। আর এতসব সম্পদই কাল হয়েছে লেক এ্যালবার্টের পাড়ের এই দেশ। কঙ্গো স্বাধীনহয়েছে ১৯৬০ সালে। কিন্তু এত বছরে শান্তিও আসেনি, নিজেদের সম্পদ নিজেরা ধরেও রাখতে পারেনি। এটা ভাগ্য নাকি পরিণতি, কে জানে !

চলবে...

বন্ধুরা আরও নানা বিষয়ে জানতে ও আপনার মতামত জানাতে https://www.facebook.com/bnlifestyle

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।