মাথা থাকলে মাথাব্যথা হবেই, স্বতঃসিদ্ধ এই কথা আমরা যুগ যুগ ধরে শুনে আসছি। আমাদের কম বেশি মাথাব্যথা হয়ে থাকে।
অনেকের বেশি দুশ্চিন্তা করলে মাথাব্যথা শুরু হয় আবার কিছুক্ষণ পর এমনিই ভাল হয়ে যায়। এই ধরনের মাথাব্যথাই সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। তবে আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের দীর্ঘদিন ধরে সময়ে অসময়ে মাথাব্যথা করে।
আমার দেখা মতে বেশিরভাগ মানুষই তাদের এই ব্যথাকে মাইগ্রেন হিসেবে অবহিত করে থাকেন। মাইগ্রেন অবশ্যই দীর্ঘদিন মাথাব্যথার একটি বড় কারণ। তবে অন্য অনেক কারণও রয়েছে যা বেশিরভাগ সময়ই ঠিক ভাবে খেয়াল করা হয় না।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে কারণটি দৃষ্টি এড়িয়ে যায় তা হল সারভাইকোজেনিক হেডেক। এই ধরনের মাথাব্যথার উৎস হল ঘাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া নার্ভ। সাধারণত ঘাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া ৮ টি নার্ভের মধ্যে প্রথম ৩ টি তে যদি কোনো রকম চাপের সৃষ্টি হয়, তাহলে সৃষ্ট ব্যথা মাথার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধরনের ব্যথার ক্ষেত্রে ঘাড়েও ব্যথা থাকতে পারে। সেই সাথে ঘাড় বিভিন্ন দিকে নাড়ালে মাথাব্যথার তারতম্যও ঘটতে পারে।
এখন আমরা আলোচনা করব কেন ঘাড়ের নার্ভে অনেক সময় চাপের সৃষ্টি হয়। আমাদের মেরুদণ্ডের মাঝখান দিয়ে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত স্নায়ু রজ্জু বা স্পাইনাল কর্ড নেমে আসে। এই স্পাইনাল কর্ড মস্তিস্ক থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা বিভিন্ন শাখা নার্ভের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে পরিবহন করে, আবার শরীরের বিভিন্ন তথ্য ও অসুবিধার কথা মস্তিস্কে পৌঁছে দেয়। স্পাইনাল কর্ড থেকে তৈরি হওয়া এই শাখা নার্ভগুলোকেই বলা হয় স্পাইনাল নার্ভ। ঘাড় থেকে এই স্পাইনাল নার্ভ যখন বের হয়, তা মেরুদণ্ডের বিভিন্ন জটিল কাঠামো ভেদ করে বাইরে বের হয়ে আসে। এই বের হয়ে আসার সময় মেরুদণ্ডের বিভিন্ন অংশের (যেমন ডিস্ক, লিগামেন্ট, মাসেল) সাথে চাপের জন্য ব্যথার উৎপত্তি হয়। এখন ঘাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া ৮ টি নার্ভের মধ্যে প্রথম ৩ টি তে যদি এই ধরনের চাপের সৃষ্টি হয় আর এই ৩ টি নার্ভ যেহেতু মাথার দিকে যায়, তাই এগুলোতে সৃষ্ট সমস্যার জন্য আমরা মাথায় ব্যথা অনুভব করি।
কেন এই নার্ভগুলোতে চাপের সৃষ্টি হতে পারে? অনেক সময়ই নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বাস, রিকশায় ঝাঁকুনির ফলে ঘাড়ের ডিস্ক সামান্য সরে গিয়ে নার্ভে চাপ দিয়ে থাকে। আবার বয়সের জন্যও অনেকের মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয়ে গিয়ে, অথবা অবাঞ্ছিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে নার্ভে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
অনেকের কাজের ধরণই এমন যে তাদের দীর্ঘ সময় নিচের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে হয়, যেমন দীর্ঘ সময় কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ব্যাবহার, ডেস্ক জব ইত্যাদি। এই ধরনের পেশাজীবীদের সারভাইকোজেনিক হেডেক বেশি হয়ে থাকে সচেতনতার অভাবে।
তাই, আপনার যদি দীর্ঘদিন মাথাব্যথা সেই সাথে ঘাড়েব্যথা থাকে এবং অনেক সময় ঘাড়ের নড়াচড়ার সাথে ব্যথার তারতম্য ঘটে, তাহলে প্রাথমিক ভাবে ধরে নেয়া যায় যে আপনার সারভাইকোজেনিক হেডেক রয়েছে। তবে এটা নির্ণয় করার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
চিকিৎসা
অনেক সময় সাধারণ মাসেল রিলাকজেন্ট, এনালজেসিক (ব্যথা নাশক) খেলেই ধীরে ধীরে সেরে যেতে পারে। তবে নার্ভের ওপর চাপ যদি ডিস্ক বা লিগামেন্টের জন্য হয়ে থাকে, তাহলে সেই চাপ সরানোর জন্য আপনাকে কিছু বিশেষ ধরনের ফিজিওথেরাপি (ডিস্ক ম্যানিপুলেশন, মবিলাইজেসন, লেজার থেরাপি), থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ ইত্যাদির প্রয়োজন হতে পারে। যদি আপনার সমস্যার কারণ এই ধরনের কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্টে না যায়, তাহলে সার্জারি করে সেই চাপ সরানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আশা করি ঘাড়ে ব্যথাসহ দীর্ঘদিনের মাথাব্যথাকে মাইগ্রেন ধরে নিয়ে হতাশায় ভুগবেন না। নিয়মিত চিকিৎসা নিলে সারভাইকোজেনিক হেডেক পুরোপুরি ভাল হয়।
লেখকের পরিচয়: ডাঃ ওসমান গনি, এম এস সি (নিউরো রিহ্যাব, ইউকে), ডিপ্লোমা ইন অর্থপেডিক মেডিসিন (বেলজিয়াম) বি, পি, টি (ডি, ইউ)।
নিউরো রিহ্যাব ও পেইন স্পেশালিষ্ট ফিজিওথেরাপিস্ট।
০১৯৩১৪০৫৯৮৬