সে কোনো বিষয় নিয়ে হতাশাগ্রস্থ কিনা, সে কি কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করছে কিনা, তার কি মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কিনা, অথবা সে কি মাদকাসক্ত হয়ে উঠছে, এ বিষয়গুলো কি আমরা খেয়াল রাখছি?
লোকাল বাসে দাঁড়িয়ে অনেকটা ফেরিওয়ালা স্টাইলে যে ব্যক্তিটি জসচেতনতামূলক কথাগুলো বলছিলেন, তার নাম সৌরভ খন্দকার। আমি বাসে বাসে জনসচেতনতা ফেরি করি, হাসি মুখে বাংলানিউজকে জানালেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের এ ছাত্র।
সৌরভ বলেন, প্রায় একবছর ধরে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন রুটের লোকাল বাসের যাত্রীদের সামনে- শিশু সন্তানের মানসিক সাহায্য, মাদকাক্তি, ধূমপান, পাবলিক টয়লেট ইত্যাদি বিষয়ের ওপর জনসচেতনামূলক কথা বলেন। তাছাড়া তিনি চেষ্টা করেন প্রতিদিন কমপক্ষে দশজনকে ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে জানান এবং ধূমপান ছাড়ার পরামর্শ দেন।
কীভাবে বা কেন সৌরভ এমন কাজে এগিয়ে এলেন? সৌরভ বলেন, তিনি এবং তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি, দু’জনই ছোট বেলা থেকে ধূমপানের ঘোর বিরোধী। এ কারণে এলাকায় তাদের আলাদা একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছিল।
স্কুল-কলেজ পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য সৌরভ ঢাকা চলে এলে দুই বন্ধুর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। অনেকদিন পর যখন আবার তাদের দেখা হয়, সৌরভ লক্ষ্য করেন- তার বন্ধুটি ধূমপান করছে। ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না সৌরভ। ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে নিজের বন্ধুকে ধূমপান থেকে দূরে সরিয়ে আনেন। পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজের অন্যদেরকেও ধূমপানের মরণ ছোবল থেকে রক্ষা করতে ছুটছেন বাস থেকে বাসে।
সৌরভ বলেন, আমি চেষ্টা করি চা-সিগারেটের দোকানে ধূমপানরত রিক্সাওয়ালা, শ্রমিক এদেরকে সচেতন করতে। কারণ, শিক্ষিত মানুষদের কাছে পৌঁছানো সহজ, তাদের জন্য অনেক লেখালেখি, টক’শো হয়। কিন্তু যারা গরিব-অশিক্ষিত তাদের কাছে কেউ ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করে না। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে যে ছবি থাকে, আমি তাদেরকে সেটা দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি - কেন তাদের এ বাজে অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া উচিত।
সৌরভের অনুপ্রেরণা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড.মো:সাইফুদ্দীন এবং ফারজানা আহমেদ। মানুষকে সচেতন করতে সৌরভের বলা কথাগুলো ঠিক আছে কিনা, তা যাচাই করে নেন এ দুজনের সঙ্গে।
সৌরভের কথায় জানা গেল, দেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মাদকাসক্তির এক ভয়াবহ চিত্র। বছরখানেক আগে দশম শ্রেণির একজন ছাত্রকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন তিনি। প্রথম থেকেই ছেলেটির আচরণে অস্বাভাবিকতা আদেখা যায়।
ছেলেটিকে ঘরের বাইরে কোথাও যেতে দেওয়া হয় না, এমনকি স্কুলেও না। বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা করা নিষেধ। আর ছেলেটি তার মা’কে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। বিষয়গুলো সন্দেহজনক ঠেকায় সৌরভ ছেলেটির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করেন। এভাবে একসময় ছেলেটির মুখ থেকে তিনি জানতে পারেন, ক্লাস সেভেন থেকে সে ইয়াবা আসক্ত।
ছেলেটার মাদকাসক্তির কথা তার অভিবাবকরাও জানতেন, অথচ তারা ছেলের ট্রিটমেন্ট করাননি। অবশেষে সৌরভ ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে ওই ছেলেটার ট্রিটমেন্ট শুরু করে। কয়েকমাসে ছেলেটা অন্ধকার পথ ছেড়ে এখন অনেকটাই সুস্থ।
সৌরভ মনে করেন, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। উন্নত দেশের নাগরিকরা যেকোনো সমস্যায় পরিবারের সবাই মিলে মানসিক চিকিৎসকের সঙ্গে কাউন্সিলিং করেন। এমনটা আমাদেরও করা উচিত।
বাসের যাত্রীদের সচেতন করতে গিয়ে বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়েছে সৌরভকে। অনেক সময় যাত্রীরা তাকে ভিখারি ভাবেন, বাসের স্টাফরা খারাপ ব্যবহার করেন।
কিন্তু এসবে দমে যাওয়ার পাত্র নন সৌরভ। তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই তাকে জড়িয়ে ধরেছেন, অনেকেই হাত থেকে ছুড়ে ফেলেছেন সিগারেট।
ভবিষ্যতে একটা ওয়েবসাইট খুলতে চান এই জনসচেতনতার ফেরিওয়ালা। যার মাধ্যমে খুব সহজেই প্রায়োজনীয় তথ্যগুলো অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮
এনএইচটি/এসআইএস