ঘরের দেওয়ালে আর টেবিলের ডেস্কে সময় এলো ক্যালেন্ডার পাল্টে দেওয়ার। একটি বছর যখন চলে যায়, আমরা ফিরে দেখি বড় ঘটনাগুলো।
২০২০, ২০ এ বিষক্ষয় না হয়ে রয়ে গেল বিষাদময়। গত একটি বছরে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে শুধুই চোখে ভাসতে হারানোর স্মৃতি।
এবছর আমরা মহামারি করোনা থেকে বেঁচে থাকার লড়াই করে গেছি শুধু। আর এজন্য আমাদের জীবনযাপনে এসেছে বড় পরিবর্তন। কেমন ছিল সেই দিনগুলো?
মাস্ক ব্যবহার
হাসপাতালে অপারেশন করার সময় সাধারণত চিকিৎসকদের মাস্ক পরতে দেখা যেত। কিন্তু এই ২০২০ সালে করোনা আসার পর বিশ্বের সব মানুষের জন্যই বাধ্যতামূলক হয়ে যায় মাস্ক। করোনা ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার করা হয়, মাস্ক নিয়েও চলছে গবেষণা, আজকাল ফ্যাশনেরও অংশ করা হচ্ছে মাস্ককে। সার্জিক্যাল মাস্ক বা কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করা হলেও, দু’একজন সোনা-রুপার মাস্কও তৈরি করেছেন।
হাত ধোয়া
হাত ধোয়া নিজেদের জীবাণুমুক্ত রাখার যে চেষ্টা এটা আগের চেয়ে অনেক-অনেক বেড়ে গেছে এবছর। সাবানের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি যোগ হয়েছে স্যানিটাইজারের ব্যবহারও।
কোয়ারেন্টাইন
একেবারেই নতুন ধারণা নিয়ে এসেছে কোয়ারেন্টাইন শব্দটি। কেউ কোথাও গিয়ে সরাসরি বাইরে ভ্রমণের সুযোগ বন্ধ-আগে ১৪ দিন ঘরবন্দি থেকে তারপর বাইরে ঘোরাঘুরি। এই ১৪ দিন ঘরবন্দি সময়কেই বলা হয় কোয়ারেন্টাইন।
আইসোলেশন
করোনার শুরুর দিকে সবচেয়ে ভয়াবহ শব্দ হয়ে দাঁড়ায় আইসোলেশন। কারো মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিলেই তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখা হয়। রোগের কষ্টের চেয়ে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে একা থাকার মানসিক চাপ যেন তীব্র কষ্টের কারণ হয়। এদিকে পরিবার আর বন্ধুদের উৎকণ্ঠার শেষ থাকে না, যখন প্রিয়জন থাকেন আইসোলেশনে।
সামাজিক দূরত্ব
মহামারি করোনায় ২০২০ শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বারবারই বলা হয়েছে অন্যজনের সঙ্গে অন্তত তিন থেকে ছয় ফিট দূরত্ব রাখতে। অবশ্য এই দূরত্ব ছিল শুধুই শারীরিক, অনলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ আর মানসিকভাবে আমরা দূরে থেকেও পাশে থেকেছি প্রিয়জনের।
লকডাউন
শুধুমাত্র হাসপাতাল ছাড়া আর কিছুই যেন খোলা হয়নি সারাদিন, রাস্তায় নেই কোনো গাড়ির শব্দ, গাছের একটি পাতাও যেন পড়তে দু’বার ভাবছে, এমনই নীরবতা নেমে আসে পুরো বিশ্বে। চিরচেনা সেই লোকের ভিড় ছিল না কোথাও।
করোনা টেস্ট-পজিটিভ-নেগেটিভ
জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্টসহ যে কোনো করোনার উপসর্গ বা করোনা রোগীর কাছাকাছি যারা ছিলেন, তাদের করোনা টেস্ট করা হয়। যাদের করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসে তাদেরকে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলতে হয়েছে। শুরুর দিকে করোনা পজিটিভ হওয়া মানে তার ও তার পরিবারের সবার জীবনেই যেন অভিশাপ নেমে আসে। পেয়ে বসে আতঙ্কে। তবে পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য গড়ে ওঠে বিশেষায়িত হাসপাতাল। চিকিৎসকদের দেওয়া হয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও পিপিই (বিশেষ পোশাক, করোনার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে না) ধীরে ধীরে মানুষের আতঙ্কও কমে যায়। করোনা পজিটিভ এলে, ১৪ দিন আইসোলেশনে থেকে তারপর আবার পরীক্ষা করাতে হয়। করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেই বন্দি জীবন থেকে মুক্তি। ফিরতে পারেন সবার মাঝে স্বাভাবিক জীবনে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
প্রায় সারা বছর স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ, শিশুদের নতুন স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন তুলে রেখেছে তাদের অভিভাবকরা। আগে তো জীবন, তারপর সব কিছু....দৌড়ে ক্লাসে যাওয়া বা বন্ধুর সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খাওয়ার পরিবর্তে এবছর অনলাইনে ক্লাস করেছে ছোট ছোট বাবুরাও।
খেলাধুলা
ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিসের জমজমাট আসরগুলো যেন চলে যায় হিম ঘরে। পিছিয়ে যায় টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপও।
থেমে যায় মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা
১৯৫২ সাল থেকে শুরু হয় দুনিয়ার সৌন্দর্যের এই লড়াই শুরু হলেও করোনায় বছর আয়োজন হয়নি বিশ্বে সাড়া ফেলে দেওয়া সুন্দরীদের প্রতিযোগিতা মিস ওয়ার্ল্ড। আয়োজকরা জানিয়ে দেন করোনার ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে অংশ নিতে প্রতিযোগিরা আসতে পারবেন না। ফলে এবছর আলোর মুখ দেখেনি এই বিশ্বসেরা এই ইভেন্ট।
ফ্লাইট বন্ধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পৃথিবী
এমন পৃথিবীর কল্পনাও কেউ করেনি। যেখানে একটি বিমানবন্দরে প্রতি মিনিটে নানা দেশের প্লেন আসে-যায়, সেখানে মাসেও একটি প্লেন ওড়েনি। বন্দরগুলোতে ছিল না জাহাজে পণ্য তোলা আর খালাসের ব্যস্ততা। থেমে যায় রাত দিনের কাজের চঞ্চলতা। বন্ধ হয়ে যায় এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যাওয়া আসা। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখা হয়।
দেশি পণ্য, ঘরের খাবার
বাইরে যাওয়া কমে গেল, প্রায় বন্ধ হলো বাইরে খাওয়া। তার পরিবর্তে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার। আর হোটেলের খাবারের জায়গা দখল করে নেয় অনেক ঘরে তৈরি করা খাবারের উদ্যোগগুলো। একইভাবে বাইরের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় বিদেশ থেকে পোশাক কসমেটিকস আসাও প্রায় বন্ধ ছিল। আগে আসা পণ্যগুলোও পাওয়া যাচ্ছিল না, কয়েকগুন দামেও। এই সুযোগে দেশি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন সবার প্রয়োজন মেটাতে। আর ছোট ছোট এই উদ্যোক্তাদের পরিচিতি এনে দিতে কাজ করে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) এর মতো প্লাটফর্মগুলো।
ভ্যাকসিন
পুরো একটা বছরে আট কোটি মানুষ আক্রান্ত হয় মহামারি করোনায়, মৃত্যু হয় ১৭ লাখের বেশি মানুষের। আর করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি মানুষ। এই ভয়াবহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মানুষ অপেক্ষার প্রহর গুনেছে। কবে পাওয়া যাবে সেই কাঙ্ক্ষিত ভ্যাকসিন বা টিকা। আর করোনার ভয়াবহ মৃত্যু আতঙ্ক থেকে মুক্ত হবে বিশ্ববাসী। বিশ্বের নাম করা সব গবেষকরা রাত-দিন এক করে চেষ্টা চালিয়েছেন, করোনা রুখতে কাজ করবে এমন টিকা আবিষ্কারের। শেষ পর্যন্ত নিরাশ করেননি গবেষকরা। রাশিয়ায় প্রথম টিকা আবিষ্কার হয় এবছরই। আর এরই মধ্যে বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সাধারণ নাগরিকরাও করোনার ভ্যাকসিন পেতে শুরু করেছে।
২০২০ সাল নিয়ে লিখতে গিয়ে আসলে করোনার বাইরে তেমন কিছুই পাওয়া গেলো না। তবে এই ২০২০ এ দাঁড়িয়েই স্বপ্ন দেখছি ২০২১ এ করোনামুক্ত নতুন ভোরের।
বাংলাদেশ সময় ১৭১৭ ঘন্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০
এসআইএস