ঢাকা: জন্ম এবং বেড়ে উঠা শহরেই। তবে গ্রামের প্রতি রয়েছে আলাদা টান।
আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা যখন বিদেশি খাবারের প্রতি ঝুঁকছি, তখন শেকড়ের টান অনুভব করে বাঙালির নিজস্ব খাবারগুলোকে আরও নান্দনিকতায় ফুটিয়ে তুলছেন মারজানা ইসলাম মেধা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এই তরুণী দেশীয় ঐহিত্যবাহী বিভিন্ন রান্না শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করে ইতোমধ্যে নজর কেড়েছেন ভোজন রশিকদেরও। আর পড়াশোনার পাশাপাশি রান্না থেকেই প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা উপার্জন করছেন অনলাইনের এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। চেষ্টা করছেন দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বাঙালি খাবারগুলোকে উপস্থাপন করার।
দেশীয় রসনায় ফোকাস করলেও ইন্ডিয়ান, চাইনিজ ও থাইফুড রান্নাতেও সিদ্ধহস্ত মেধা। তার রান্নার হাতের জাদুতে ইতিমধ্যেই মজেছেন হাজারো রসনা বিলাসী। রান্না করে জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি পুরষ্কারও ঘরে তুলেছেন এই মেধাবী নারী উদ্যোক্তা। অর্জনের ঝুড়িতে রয়েছে বিটিইএ বর্ষসেরা রন্ধনশিল্পী ২০২১, বিটিইএ বর্ষসেরা রন্ধনশিল্পী ২০২২ ও বিসিক উদ্যোক্তা সম্মাননা ২০২২ সহ আরও বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা।
আলাপচারিতায় মেধা জানান, শুধু রান্না করেই থেমে থাকেন না তিনি। এ রান্নাগুলোকে আরও কীভাবে উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সে ব্যাপারেও প্রচেষ্টা রয়েছে তার। দেশীয় খাবারগুলোকে আরও বেশি মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়াসহ বৈশ্বিকভাবে কিভাবে জনপ্রিয় করা যায় সে বিষয়েও গবেষণা করছেন তিনি।
দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার, বিশেষ করে রান্নার পদ্ধতি ও ওই এলাকার রান্নার নিজস্বতা তুলে ধরতে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত। নিজের নতুন স্বাদের রন্ধন পদ্ধতির উদ্ভাবনী প্রচেষ্টায় সফলও হয়েছেন। নিজের মেধা, মনন এবং সৃজনশীল উদ্ভাবনী শক্তির আলোচিত হয়েছেন রসনার জগতে।
কিভাবে রান্নার জগতে আসা-এমন প্রশ্নের জবাবে মেধা জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই আম্মুকে দেখতাম রান্না করতে, আম্মুকে সাহায্য করতে করতে একটা সময় নিজের রান্নার প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেল,সবাই আম্মুর খাবার খেয়ে প্রশংসা করতেন তখন মনে হতো, ইশ! আমার রান্না খেয়ে কবে সবাই প্রশংসা করবে? তাই রান্নাকেই উদ্যোগ হিসেবে নিয়ে নিলাম।
দেশীয় রান্নায় মনোযোগী হওয়ার বিষয়ে মেধা বলেন, ‘আমি যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক তাই আমি রান্না শিখতে এবং জানার সময় উপলব্ধি করলাম দেশীয় খাবারগুলো হারিয়ে যাচ্ছে তাই দেশি-বিদেশি রান্না জানলেও দেশিও খাবারের প্রতি টান চলে আসে এবং এখানটায় কাজ করার আগ্রহ জেগে উঠে।
কিভাবে এসব রান্না ভোক্তার কাছে পৌঁছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আমার রান্নার মার্কেটিং শুরু হয় অনলাইনের মাধ্যমে, আমি আমার এলাকার বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যুক্ত হই এবং সেখানে প্রতিদিন খাবার এবং গুণগত মান নিয়ে পোস্ট করতে করতে আমি আমার কাস্টমার পেয়ে থাকি’।
মেধা জানান, ‘সাধারণত তার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘মেধা’স ফুড কর্নার’র মাধ্যমে বিক্রি হয়, ডেলিভারি ম্যান তাদের কাছে পৌঁছে দেন। প্রয়োজনে মাঝেমাঝে নিজেই ডেলিভারি ম্যান হয়ে যান।
মেধা আরও জানান, ‘সাধারণত তার রান্নার ভোক্তা তার এলাকার ও আশেপাশের প্রতিবেশী এবং অনলাইনের ক্রেতারা।
এখান থেকে আয়ের বিষয়ে মেধা জানান, যেহেতু রান্নার বিষয়টি এখনও ফুল টাইম না- পড়ালেখার পাশাপাশি করতে হয়। তাই এখন এখান থেকে আহামরি আয় না থাকলেও প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় থাকে।
তার রান্নার এই উদ্যোগে পরিবারের সমর্থন কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তরে মেধা বলেন, ‘পরিবার থেকে ব্যাপক পরিমাণে সাপোর্ট পাই বেশি সাপোর্ট পাই আমার আম্মুর থেকে, তিনি আমার মেন্টর’।
মেধার রান্নার হাত নিয়ে কথা হয় তার কয়েকজন ভোক্তার সঙ্গে। আফরোজা আব্বাস নামের এক ভোক্তা জানান, ‘দীর্ঘদিন মেধার হাতের রান্নার প্রশংসা শুনে আসছিলাম। খেয়ে বলতেই হলো, ‘মেয়েটা অসাধারণ রান্না করে।
মাহবুব হাসান নামের আরেকজন জানান, ‘মেধার রান্নার হাত অনেক ভালো। বিশেষ করে তার হাতের বিফ আইটেমগুলো অনেক ভালো হয়।
সাইফুজ্জামান নামের আরেকজন জানান, ‘মেধার রান্না অনবদ্য’। রান্নাও যে একটা শিল্প-এটা বুঝতে হলে মেধার রান্না খেতে হবে।
মারজানা ইসলাম মেধা ১৯৯৯ সালের ১২ জুলাই ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র মোহাম্মদপুরে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে ট্রিনিটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মোহাম্মদপুর থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১৯ সালে ওয়াইড ভিশন কলেজ উত্তরা থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০২১ বিএসসি (ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং) নিয়ে এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করছেন। পাশাপাশি প্রফেশনাল কুকিং একাডেমি থেকে লেভেল ওয়ান এবং টু সম্পন্ন করছেন।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি নানা রকম সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ছাত্র জীবনে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। সমাজসেবামূলক কাজেও তিনি পিছিয়ে নেই। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তিনি গার্লস গাইড নেতৃত্ব দিয়ে পেয়েছেন সম্মাননা। ২০১০ সাল থেকে নিয়মিত ছায়ানটের শিশুশিল্পী হিসেবে যোগ দিয়ে ২০১৭ সালে জাতীয় নৃত্যশিল্পী পুরস্কার অর্জন করেন।
বাবা রেমিটেন্স যোদ্ধা সাইদুল ইসলাম ও গৃহিণী মা শামিমা ইসলাম। তাদের ভালোবাসা, আদর সোহাগ আর আহ্লাদে শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন মারজানা ইসলাম মেধা।
মেধার যত রান্না:
অনেক রকম রান্না করলেও মেধা’র বেশ কয়েকটি রান্না ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর মধ্যে নারকেলি মুরগি মাংস, নারকেলি গরু মাংস, পোলাও, কাতল মাছের কালিয়া, ইলিশ ভাপা, ছানার জিলাপি, পায়েস লাড়ু। গরুর মাংস, চিংড়ি ভুনা, সিসলিং, মাছ ভুনা, ক্ষীর,পুডিং ও জর্দা।
এছাড়াও রয়েছে লাঞ্চ ও ডিনার বক্স। প্যাকেজ আকারে বিক্রি হয় এই বক্স। প্যাকেজে থাকে ভাত, মাছ, সবজি ডাল অথবা ভাত, মুরগি,সবজি ডাল ভুনা অথবা ভাত, ডিম ভুনা, সবজি ডাল অথবা ভাত, ৪ রকম ভর্তা, সবজি ডাল। এছাড়াও রয়েছে
খিচুড়ি /পোলাও,গরুর মাংস/ রোস্ট / সবজি। প্রতি প্যাকেজে দাম ধরা হয় ১০০ টাকা।
মেধা জানান, সর্বোচ্চ মানের দিক খেয়াল রেখে খুব অল্প লাভ করার চেষ্টা করি। এর ফলশ্রুতিতে ক্রেতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২২
এসএইচডি/এএটি