লন্ডন: একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ওয়্যার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের রেখে যাওয়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামের নাগরিক আন্দোলনেরই ফসল।
এই আন্দোলন শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে জোয়ারও সৃষ্টি করেছিল এটি।
সোমবার ১৯ জানুয়ারি বিকেলে পূর্ব লন্ডনের মন্টিফিউরি সেন্টারে সংগঠনের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখা আয়োজিত নেতাকর্মীদের এক পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এ সব মন্তব্য করেন।
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও যুক্তরাজ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আনসার আহমেদ উল্লার সভাপতিত্বে এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিলেন বর্তমানে ব্রিটেনে বসবাসরত একাত্তরের ছয়বীর মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলর খলিল কাজি, ইসহাক কাজল, কয়সর সৈয়দ, লোকমান হোসেইন, আব্দুল হামিদ ও ফয়জুর রহমান খান।
নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের সঙ্গে এই ছয়বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজ নিজ দৃষ্টিতে নির্মূল কমিটির বিগত ২৩ বছরের আন্দোলন বিশ্লেষণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে এক সময় গর্ব করে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলেও, সেই সুখকর সময়টি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
জাতির জনককে রক্ষায় ব্যর্থতা পরবর্তীতে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগতো।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের পর একাত্তরের ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম আযম যখন প্রকাশ্যে জামায়াতের আমির হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আভির্ভূত হন, তখন ভয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে নিজের পরিচয় আর প্রকাশ করতাম না।
তিনি বলেন, আমাদের এই ‘লজ্জা’ ও ‘ভয়’ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের মাধ্যমে গণআদালত বসিয়ে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে তিনি যখন ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম আযমের প্রতীকী মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন, ঠিক তখনই আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সব লজ্জা, সংকোচ ও ভয় নিমিষেই উড়ে যায়। নতুন করে যুদ্ধে যাওয়ার সাহস তৈরি হয় নিজেদের মধ্যে।
তিনি বলেন, আর এ কারণেই নির্মূল কমিটি নামে এই নাগরিক আন্দোলনকে আমি মনে করি, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার আন্দোলন।
যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত সফলতা না আসা পর্যন্ত নির্মূল কমিটির আন্দোলন অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে অনুষ্ঠানের অন্যান্য বক্তারা বলেন, ক্ষমতা লোভহীন এই আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব সব শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার আদায় ও বিচারের রায় বাস্তবায়ন করা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বর্তমান নতুন প্রজন্মের আগ্রহ ও আকর্ষণ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে বক্তারা বলেন, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে বাংলাদেশের এই প্রজন্মের মধ্যে যে দুনিয়া কাঁপানো গণজাগরণ বিষ্ফোরিত হয়েছিল, সেটিও নির্মূল কমিটির দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের আদর্শ মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদ চিরতরে নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি প্রজন্ম নির্মূল কমিটির চলমান নাগরিক আন্দোলন অব্যাহত রাখবে, এই গণজাগরণ এ বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছে।
অনুষ্ঠানের ঘোষণায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু ও চলমান রাখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দণ্ডিত সব যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর করার দাবি জানানো হয়। ঘোষণায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সব ধরনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকারও আহ্বান জানানো হয় সবার প্রতি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- সংগঠনের যুক্তরাজ্য শাখার সহসভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম, ইসহাক কাজল, সহসাধারণ সম্পাদক জামাল খান, গবেষণা সম্পাদক সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক রুবি হক, আন্তর্জাতিক সম্পাদিকা পুষ্পিতা গুপ্তা, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অজন্তা দেব রায়, নির্মূল কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদিকা সৈয়দা নাজনিন সুলতানা শিখা, প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক আবু শহিদ, বর্তমান কমিটির নির্বাহী সদস্য আলী আকবর চৌধুরী, কর্মী মাহজাবিন টুম্পা ও যুক্তরাজ্য ন্যাপ সভাপতি আব্দুল আজিজ ময়না প্রমুখ।
শিশু আনভিতা গুপ্তার নেতৃত্বে পরিবেশিত হয় জাতীয় সঙ্গীত। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে উপস্থিত সবাইকে মিষ্টিমুখও করানো হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫