ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লন্ডন

‘সহিংসতার অভিযোগ খণ্ডনের জন্যে অংশ নেয়া উচিত ছিলো বিএনপি’র’

সৈয়দ আনাস পাশা, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৫
‘সহিংসতার অভিযোগ খণ্ডনের জন্যে অংশ নেয়া উচিত ছিলো বিএনপি’র’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হাউস অব লর্ডস, লন্ডন থেকে:  ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আয়োজিত বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনারে বিএনপি অংশ না নেয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ার ও ব্রিটেনের প্রবীণ রাজনীতিক লর্ড এইভব্রি।

যেসব যুক্তিতে বিএনপি এই সেমিনারে অংশ নেয়নি তাকে ‘ভুয়া’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।



মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত হাউস অব লর্ডসের একটি কমিটি রুমে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ: ইলেকশন, ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য রোল অব ল’ শীর্ষক সেমিনারে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে লর্ড এইভব্রি এই মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, মামলার কারণে নেতাদের বিদেশে যেতে না পারার যে কারণ বিএনপি দেখিয়েছে তা ‘ভুয়া’। বিএনপির একাধিক নেতা এখনও লন্ডনে রয়েছেন, রয়েছেন অন্যান্য দেশেও। ইচ্ছে করলে তাঁরা আসতে পারতেন। নিজেদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সহিংস আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাস সম্পৃক্ততা ইত্যাদি অভিযোগ খণ্ডনের জন্যেই তাদের আসা উচিত ছিলো। যোগ করেন লর্ড এইভব্রি।

লর্ড এইভব্রি’র সাথে সেমিনারের কো চেয়ার ছিলেন বাংলাদেশ বিষয়ক অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ার আন মেইন এমপি।

সূচনা বক্তব্যে সম্প্রতি দুই বিদেশি হত্যা, পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিতে হামলা ও ব্লগারদের হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন লর্ড এইভব্রি।

সেমিনারে উপস্থিত হয়ে তা ফলপ্রসূ করার জন্যে তিনি তাঁর সমাপনী বক্তব্যে সরকার দলীয় প্রতিনিধি দল ও জাপা প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানান।

সেমিনারে দেশের স্বার্থের প্রশ্নে একই সুরে কথা বলেন বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী এই দিকটি ব্রিটিশ এমপি ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদেরও আকৃষ্ট করেছে।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এই সেমিনারে উপস্থিত না থাকলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এতে অংশ নেয়।

বাংলাদেশের ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নিয়ে লর্ড কার্লাইল ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজের কোন কোন অভিযোগের জবাবে একই সুরে কথা বলেন আওয়ামী লীগ ও জাপা প্রতিনিধিরা। আর এই দুই ব্রিটিশ পার্টিসিপেন্টের অভিযোগের জবাবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের যুক্তিপূর্ণ জবাব সেমিনারে উপস্থিত সবার কাছে খুবই প্রশংসিত হয়।

দুই বিদেশি হত্যা, পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিতে হামলা ও ব্লগারদের হত্যার ঘটনায় লর্ড এইভব্রি’র উদ্বেগের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বাংলাদেশে সহিংসতা ও নাশকতার জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেন।

১৯৭১-এ স্বাধীনতা বিরোধীদের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান কর্মকাণ্ড অনুধাবন করতে হলে তাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, বিএনপি’র অন্যতম বড় ভুল হলো ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে পরাজয়ের পরও জামায়াতের মত স্বাধীনতা বিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠনকে সঙ্গে রাখা। লর্ড কার্লাইল এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজের ওয়ারক্রাইম ট্রায়ালের সমালোচনার জবাবে এইচ টি ইমাম বলেন, বিশ্বে এমন আর কোন ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নেই, যেটিতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তা আবার রিভিউয়ের সুযোগ আছে। বাংলাদেশের বর্তমান স্থিতিশীল অবস্থা টিকিয়ে রাখতে তিনি ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির সহযোগিতা কামনা করেন।  

লর্ড কার্লাইল বাংলাদেশের ওয়ারক্রাইম ট্রায়াল আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।

ব্রিটেনের আইনজীবীরা এই ট্রায়ালের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কার্লাইল এমন মন্তব্য করলে এর উত্তরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তাঁর কাছে জানতে চান এমন একপেশে অভিযোগ তোলার অথরিটি সব আইনজীবীর কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন কী না ?

একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নিজস্ব জুডিশিয়ারি সিস্টেমের প্রতি সব দেশের শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত মন্তব্য করে তারানা হালিম বলেন, কোন একটি দেশের জুডিশিয়ারি সিস্টেম সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে সে সিস্টেম সম্পর্কে মন্তব্যকারীর ভালোভাবে জানা উচিত।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজ যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে অভিযুক্তদের আইনজীবীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে মন্তব্য করলে, কোন আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা জানতে চান তারানা হালিম। উত্তরে আব্বাস ফয়েজ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীর কথা জানালে তারানা হালিম বলেন, রায় ঘোষণার আগেই ঘুষ দিয়ে এই রায় বাইরে প্রচার করার ষড়যন্ত্রের দায়ে এই আইনজীবীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এটির সাথে ট্রায়ালের মান বজায় থাকা বা না থাকার কি সম্পর্ক আব্বাসের কাছে তা জানতে চান তারানা।

অ্যামনেস্টির মৃত্যুদণ্ডের সমালোচনার জবাবে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে আব্বাস ফয়েজের কাছে জানতে চান, আমেরিকায় যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, সে বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কী করছে?  

যুদ্ধাপরাধের দায়ে শুধুমাত্র জামায়াত নেতাদেরই বিচার হচ্ছে, এমন অভিযোগ খণ্ডন করে তারানা হালিম বলেন, শুধু জামায়াত নয়, বিএনপি এমনকি আওয়ামী লীগ নেতারও বিচার হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে। সুতরাং এই বিচারকে রাজনৈতিক বিচারের রং মাখানোর চেষ্টা কোনভাবেই সফল হবে না।

একটি সাধারণ অপরাধের সাথে যুদ্ধপরাধকে একই পাল্লায় মাপা কি উচিত? অ্যামনেস্টির প্রতি এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তারানা হালিম বলেন, মানবাধিকার তো কোন একটি পক্ষের খণ্ডিত অধিকার নয়, একজন যুদ্ধাপরাধীর মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে চাইলে ১৯৭১ সালে তার হাতে নিহত শহীদদের মানবাধিকারের কথা আগে বলতে হবে।

অ্যামনেস্টির আব্বাস ফয়েজের অভিযোগের জবাবে সাবেক আইন মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া বর্ণনা করে বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সব ধরনের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের ন্যায় বিচার পাওয়ার এমন সুরক্ষা আর কোন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নে উভয় পক্ষে তীব্র বিতর্ক শুরু হলে সেমিনারের সঞ্চালক বাংলাদেশ বিষয়ক অল পার্টি পার্লামেন্টারি কমিটির চেয়ার অ্যান মেইন শুধু আইনি বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি ‘লিগ্যাল কনফারেন্স’ অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অর্জনের কথা তুলে ধরেন সেমিনারে।

সামাজিক অগ্রগতি তুলে ধরে বক্তব্য দেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম এ হান্নান। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, আমি নিজে জেনেভায় দায়িত্ব পালন করে এসেছি। সেখানে কেউ কখনও আমাদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অভিযোগকে তিনি ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যা তুলে ধরে বক্তব্য দেন অজিত সাহা ও শুশান্ত বড়ুয়া। তাদের উদ্বেগের বিষয়ে জবাব দেন প্রতিমন্ত্রী বীরেন সিকদার। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম ও সেলিম উদ্দিন বাংলাদেশের নানা ইতিবাচক দিক তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৫
আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

লন্ডন এর সর্বশেষ