লন্ডন: এতোদিন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি থেকে ‘জেহাদি’ রপ্তানি হলেও এখন ব্রিটেন থেকেও তা হচ্ছে অভিযোগ করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, সভ্য দুনিয়ার পথিকৃৎ দাবিদার ব্রিটেনে থেকেও ‘জেহাদি’ রপ্তানি হচ্ছে। তাদের নামের সঙ্গে এই কলঙ্ক লেগেছে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের মত দণ্ডিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দুধ কলা দিয়ে পোষার কারণে।
বৃহস্পতিবার (৩ ডিসেম্বর) পূর্ব লন্ডনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের সহযোগিতায় ‘ধর্মের নামে জঙ্গিবাদের উত্থান: আমাদের করণীয় শীর্ষক’ এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
এতে শাহরিয়ার কবির ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) শামীম মোহাম্মদ আফজাল, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. আলিম চৌধুরীর কন্যা ড. নুজহাত চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের প্রবীণ সংগঠক সুলতান শরীফ, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম নেতা বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আনসার আহমেদ উল্লা, যুক্তরাজ্য কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইসহাক কাজল, সহ-সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম, সহ-সাধারণ সম্পাদক জামাল খান, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শাহ বেলাল ও এনামুল হক প্রমুখ।
নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি বলেন, ব্রিটেনে তৈরি হওয়া আইএস জেহাদি যখন ঢাকায় গিয়ে ধরা পড়ে, তখন আমরা শংকিত না হয়ে পারি না। গণতন্ত্র, মুক্তবুদ্ধিচর্চা ও সভ্য দুনিয়ার পথিকৃৎ দাবিদার এই দেশ আজ দণ্ডিত ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী ও উগ্র-মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। এ কারণেই বাংলাদেশের মতো দেশেও ব্রিটেন থেকে জেহাদি রপ্তানি হয়, বিষয়টি ব্রিটিশ রাজনীতিকরা কিভাবে দেখছেন আমি জানি না, তবে আমরা শঙ্কিত।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৯৬ সালে ওয়ারক্রাইম ফাইল প্রচার হওয়ার পর বাঙালি অধ্যুষিত বেথনালগ্রিন-বো’র তৎকালীন এমপি উনা কিং বলেছিলেন, আমার এলাকায় এতোবড় যুদ্ধাপরাধীর অবস্থান আমি জানতাম না।
তিনি বলেন, চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে মৃত্যুদণ্ডকে যদি ব্রিটেন বাধা হিসেবে মনে করে, তাহলে এখানেই তার বিচারের উদ্যোগ কেন নেওয়া হয় না।
জামায়াতকে দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গি সন্ত্রাসীদের ‘গডফাদার’ মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্সের কারণে জামায়াত এখন সেখানে কোণঠাসা। এরা এখন ব্রিটেনে এসে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চালাচ্ছে অপপ্রচার, আইএসকে বাংলাদেশে নিতে চালাচ্ছে অবিরাম প্রচেষ্টা। আর এসবই হচ্ছে চৌধুরী মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বে।
সম্প্রতি পাকিস্তান কর্তৃক একাত্তরের গণহত্যাকে অস্বীকার করার স্পর্ধায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যথেষ্ট হয়েছে, এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে হলে পাঁচটি বিষয়ের ফয়সালা করতে হবে। একাত্তরের গণহত্যার জন্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়া, বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া, বিহারিদের ফেরত নেওয়া, একাত্তরের ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং জেহাদি রপ্তানি বন্ধ করার মাধ্যমেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ বিষয় সামনে রেখেই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নে আমাদের সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ডিতদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে একাত্তরের শহীদ পরিবার ও দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নয়নে কাজে লাগানোর দাবি জানিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, এটি কোনো নতুন বিষয় নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসিদের সম্পত্তিও এভাবে বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে শামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেন, শুধু বিমান হামলা করলেই আইএস দমন হবে না, জঙ্গি সন্ত্রাসীদের মূল উৎস কোথায় তা খুঁজে বের করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব মূল উৎস না খুঁজে নিজেদের অস্ত্র বাণিজ্য ও তেলের জন্য এই সন্ত্রাস জিইয়ে রাখতে চায়। ধর্মের নামে সন্ত্রাস থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে এশিয়ান দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া ও চীনকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।
ইসলামের অপব্যাখ্যা করে জামায়াত-মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনগুলো আইএস গঠনের পেছনে মদত দিচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমাদের নবী করিম (স.) পৃথিবীতে এসেছেন মানুষকে কলেমা শেখাতে, কোনো নির্দিষ্ট ভূমি বা জমিনকে নয়, ইসলামের নামে কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে নয়।
তিনি বলেন, কোনো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য নয়, ইসলাম এসেছে পুরো মানব জাতির জন্যে। জামায়াতের মতো সংগঠনগুলো আজ এই ইসলামকে তাদের নিজেদের স্বার্থে দলীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করছে।
শহীদ সন্তান ড. নুজহাত চৌধুরী তার বাবার হত্যাকারীদের গডফাদার চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ব্রিটেনের প্রতি দাবি জানিয়ে বলেন, মঈনুদ্দিনদের মত উগ্র, জঙ্গি ও যুদ্ধাপরাধীদের কারণেই তোমাদের সমাজে আইএসের মত জঙ্গি জন্ম নিচ্ছে।
তিনি বলেন, ইসলামকে বিকৃত করে মঈনুদ্দিনরা পৃথিবীব্যাপী যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে হলে এই বিষবাষ্প ছড়ানো এখনই বন্ধ করতে হবে।
ড. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ধর্মের নামে সন্ত্রাস শুধু সন্ত্রাস নয়, এটি একটি আদর্শিক লড়াই। এই লড়াই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে যার যার ধর্ম নিয়ে বসবাসের বিরুদ্ধে নিজ নিজ ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। আমাদের সন্তানরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে চলবে না-কি ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, এর কোনটি আমরা চাই, এটি আমাদের এখনই ভেবে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৫
এইচএ/