লন্ডন: পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় গত ৩০ নভেম্বর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে গণহত্যার দায় অস্বীকার করায় শুধু বাঙালি নয়, পাকিস্তানিদের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির বর্তমান তরুণ প্রজন্ম তাদের পূর্ব প্রজন্মের দ্বারা সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম ওই গণহত্যায় লজ্জিত।
একাত্তরের গণহত্যার কথা স্বীকার করে অবিলম্বে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার জন্যে নিজ দেশের সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা। ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানিয়ে তরুণ পাকিস্তানিদের একটি গ্রুপ ইতোমধ্যে একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর সংগ্রহ ক্যাম্পেইন শুরু করেছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার দায় অস্বীকারের খবর জানিয়ে ‘উই পাকিস্তানিজ অ্যাপোলোজাইস টু বাংলাদেশিজ’ শীর্ষক ওই পিটিশনে বলা হয়, ‘আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী পাকিস্তানিরা ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে আমাদের নামে সংঘটিত নৃশংসতায় দু:খ প্রকাশ করছি’।
ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ৪শ’ পাকিস্তানি ওই অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন জানিয়ে পিটিশনের মূল উদ্যোক্তা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত তরুণ ইমাদুদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরদাতা সবাইকে প্রতিজনে আরও ৫টি করে স্বাক্ষর সংগ্রহের অনুরোধ জানিয়েছেন। সকল পাকিস্তানির প্রতি এ ক্যাম্পেইনে অংশ নেওয়ারও আহবান জানান ইমাদুদ্দিন।
ব্রিটেনের মর্যাদাপূর্ণ বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত তরুণ/তরুণীরা এ স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান পরিচালনায় অংশ নিচ্ছেন। স্বাক্ষর সংগ্রহ ক্যাম্পেইনে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি নাগরিক স্বাক্ষর করছেন, ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে মতামতও দিচ্ছেন।
স্বাক্ষর দিতে গিয়ে আমিমা সাইদ নামের একজন বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অনেকের সঙ্গে মিলিত হয়েছি, যাদের এখনও মনে আছে, একাত্তরে জামায়াতের সহযোগিতায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি আর্মির নৃশংসতার কথা। পাকিস্তানি আর্মির নৃশংসতার স্বাক্ষর মানুষের কঙ্কাল সমৃদ্ধ সেইসব গণকবরও আমি দেখেছি বিভিন্ন ডকুমেন্টারিতে’।
তিনি বলেন, ‘একজন পাকিস্তানি হিসেবে আমি যেমন লজ্জিত পাকিস্তানি আর্মির ওইসব প্রতিটি নৃশংসতায়, ঠিক তেমনি লজ্জিত একাত্তরে গণহত্যার দায় অস্বীকার করে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক ভূমিকায়। আমি এ পিটিশনে স্বাক্ষর করেছি। আমি চাই, পাকিস্তান অবিলম্বে একাত্তরের গণহত্যার জন্যে বাংলাদেশ ও দেশটির জনগনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুক’।
সাদিয়া বুকারি নামের আরেকজন বলেছেন, ‘আমি ক্ষমাপ্রার্থী ওইসব নারী ও বালিকাদের কাছে, যারা একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের শিকার হয়েছেন। আমি ক্ষমাপ্রার্থী ওইসব মায়েদের কাছে, যারা হারিয়েছেন তাদের সন্তানদের, ক্ষমাপ্রার্থী ওইসব নারীদের কাছে, যারা স্বামী হারিয়ে হয়েছেন বিধবা’।
আলিশবা নাইম বলেন, ‘আমি মনে করি, পকিস্তানের প্রতিটি নাগরিকেরই উচিত বাংলাদেশিদের কাছে ক্ষমা চাওয়া। এ ক্ষমা চাওয়া হতে পারে দু’টি জাতির মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার সেতুবন্ধন’।
তানভির খান বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘তোমরা আমাদের পরিবারে ছিলে, এখনও আছো। একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মি তোমাদের সঙ্গে যা করেছে তা লজ্জাজনক। আশা করি, তোমরা আমাদের ক্ষমা করবে। আমার প্রার্থনা, তোমাদের দেশ উত্তোরোত্তর সমৃদ্ধ হোক, শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে সবসময় বসবাস করো তোমরা’।
আলী সাইদ বলেন, ‘দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনাই হলো এসব নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি রোধের প্রথম পদক্ষেপ জাইন হাসান বলেন, যুদ্ধাপরাধ একটি জাতির ভেতরে তীব্র ঘৃণার জন্ম দেয়। আমরা চাই ঘৃণামুক্ত, কলুষমুক্ত শান্তিময় বিশ্ব’।
সাদাফ আহমেদ বলেন, ‘পাকিস্তানি আর্মি যে নৃশংসতা করেছে, তা আমার নামে করার কোনো অধিকার নেই তাদের’।
অসিম বেলগাউমি বলেন, ‘আমি স্বাক্ষর করছি এ কারণে যে, এমন নৃশংসতা করা হয়েছে আমাদের নামে। বাংলাদেশিদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী’।
ইয়াসমিন এইডরাজ বলেন, ‘আজ আমরা যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে স্বাক্ষর দিচ্ছি, এটি আরও অনেক আগেই করা উচিত ছিলো। তবুও ভালো দেরিতে হলেও শুরু তো হয়েছে। একাত্তরে যেসব বাংলাদেশি পাকিস্তানি আর্মি ও জামায়াতের হাতে নৃশংসতার শিকার হয়েছেন, আমার হৃদয়ের অন্ত:স্থল থেকে তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’।
ওয়াজহি ফারুকী বলেন, ‘আমার পূর্ব প্রজন্মের নেতাদের ভুলের কারণে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বাংলাদেশের ভাই-বোনদের আমি ভালোবাসি’।
সৈয়দ মেহদি বলেন, ‘জাতি হিসেবে যদি আমাদের আগাতে হয়, তাহলে ‘কালো অতীতের’ দায় অবশ্যই আমাদের নিতে হবে’।
জাহরা আমির বলেন, ‘পাকিস্তান আর্মি বাংলাদেশিদের সঙ্গে যেটি করেছে তা অগ্রহণযোগ্য, অবিবেচনাপ্রসূত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। একজন পাকিস্তানি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে আমি লজ্জাবোধ করি। কারণ, একই রকম নৃশংসতা আমরা এখনও করছি বেলুচিস্তান, ওয়াজিরিস্তান, গিলজিট-বাল্তিস্তান এবং সিন্দ’র প্রতিও’।
এদিকে, ব্রিটেনের বিভিন্ন মরযাদাপূর্ণ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত তরুণ পাকিস্তানি বংশোদ্ভূতদের মধ্যেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একাত্তরের গণহত্যার দায় অস্বীকারে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের (এলএসই) পোস্ট গ্রাজুয়েট ইন কমপারেটিভ পলিটিক্সের ছাত্র উসামা খিলজি বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক পাকিস্তানি একটি অপরাধবোধের মধ্যে বসবাস করছেন, যেটি হলো একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান আর্মির গণহত্যা। এতো বড় একটি গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করতে রাষ্ট্র যখন অস্বীকার করে, তখন এটি আমাদের জন্যে আরও বড় ট্র্যাজেডি হয়ে দেখা দেয়’।
পাকিস্তানিদের পক্ষে নিজে ক্ষমা প্রার্থনা করে খিলজি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার অন্ত:স্থল থেকে বাংলাদেশিদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমরা লজ্জিত। বাংলাদেশিদের আমরা ভালোবাসি’।
তিনি বলেন, ‘আমি জানি, শুধু ক্ষমা প্রার্থনা বাংলাদেশিদের মন থেকে পাকিস্তানি আর্মির নৃশংসতার ক্ষত সারাতে পারবে না। এরপরও অন্তত ভবিষ্যত শান্তির জন্যে হলেও তো এটি একটি পদক্ষেপ হতে পারে।
‘দু’টি দেশের জনগণের এই ইমোশন পাকিস্তান সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে’- বাংলানিউজের কাছে এমন মন্তব্য করেন উসামা খিলজি।
ব্রিটেনের কভেন্ট্রিতে বসবাসরত পাকিস্তানি তরুণ হাসান নিজামী বাংলানিউজকে বলেন, ‘একাত্তরের নৃশংসতার জন্যে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়’।
বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৫
এএসআর