লন্ডন: ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী মতাদর্শ মোকাবেলায় শুধু সরকারের অ্যাকশনই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। তরুণ প্র্রজন্মকে এই ক্যান্সারের মতো মতাদর্শের খপ্পর থেকে বাঁচিয়ে রাখতে অভিভাবক ও ধর্মীয় নেতাসহ সমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
এসব কথা বলছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সদস্য এবং জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য রুশনারা আলী। সম্প্রতি পার্লামেন্টের কমিটি রুমে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা করেন তিনি।
রুশনারা সিরিয়ায় ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর হামলা, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট মনোনয়নপ্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মুসলিমবিরোধী মন্তব্য, বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেট (আইএস) আতঙ্ক ও এই গোষ্ঠীটির প্রতি ব্রিটেনের তরুণ প্রজন্মের ক্ষুদ্র একটি অংশের আগ্রহ নিয়ে কথা বলেন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ এমপি বলেন, পবিত্র ধর্ম ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। ইসলামের শ্বাশত শান্তির দর্শন উপেক্ষা করে এরা মানুষের রক্ত নিয়ে হোলিখেলায় মেতে উঠেছে। এদের প্রতিরোধ করতে শুধু রাষ্ট্রের অ্যাকশনই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ইসলামের শ্বাশত শান্তির বাণীর আলোকে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করে প্রকৃত ইসলামিক স্কলারদের একাডেমিক আলোচনা, জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক, ধর্মীয় নেতা ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্টসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ধারাবাহিক কর্মসূচি নেওয়া।
রুশনারা আলী বলেন, আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলামে তো কোনো ঘৃণার স্থান নেই। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রাদায়ের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখেই আবহমানকাল থেকে আমাদের পূর্ব প্রজন্ম এই সমাজে বসবাস করে আসছেন। ধর্মীয় নেতারা যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করেছেন, কারও সঙ্গে কারও সংঘাত-সংঘর্ষ হয়নি। তাহলে আজ কেন এর ব্যতিক্রম?
তিনি প্রশ্ন রাখেন, শান্তির ধর্ম হিসেবে পবিত্র ইসলাম যেখানে পুরো মানব জাতির কাছে পরিচিত, সেখানে কারা আজ এই ধর্মকে বিতর্কিত করতে চায়? খেলাফত বা ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠার নামে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে কারা আজ রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছে? বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কারা ঘৃণার আগুন উস্কে দিতে চায় বা কেনই বা চায়।
রুশনারা বলেন, এই প্রশ্নগুলো ও এর উত্তর নিয়ে তরুণ প্রজন্মের সামনে দাঁড়াতে হবে প্রকৃত ইসলামিক স্কলারদের।
ব্রিটেনের তরুণ প্রজন্মের ক্ষুদ্র একটি অংশের আইএস আকর্ষণে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ এমপি বলেন, শুধু জঙ্গি দমন নয়, জঙ্গিবাদ সৃষ্টির চেষ্টাও ঠেকাতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষা সুযোগ বঞ্চিত তরুণ-তরুণীদেরই জঙ্গিরা তাদের মতাদর্শে টেনে নিচ্ছে। প্রতিটি তরুণ-তরুণীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বিনোদন ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে এটি রোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সন্তান ঠিকমত কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে কি-না, অবসর সময় কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে যাচ্ছে এ বিষয়গুলো নিয়মিত মনিটর করার চেষ্টা থাকতে হবে অভিভাবকদের।
রুশনারা বলেন, মূলধারায় আমাদের (ব্রিটিশ-বাংলাদেশি) অবস্থান সৃষ্টির চলমান প্রচেষ্টার এই সময়ে টেরোরিস্ট আইডলজি থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে হবে।
মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্ততার ওপর গুরত্বারোপ করে সন্তানদের এ বিষয়ে উৎসাহিত করতে অভিভাবকদের প্রতি ভূমিকা রাখারও আহবান জানান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই এমপি।
অতীতে তালেবান-আল কায়েদা এবং সাম্প্রতিক সময়ে আইএস-আইসিস নির্মূলে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সামরিক অভিযানের বিষয়ে রুশনারা বলেন, সন্ত্রাস আক্রান্ত একটি ভূখণ্ডের মানুষদের রক্ষায় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের ভাবতে হবে ওই ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি। সামরিক হামলায় যদি সাধারণ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা বেশি থাকে, তাহলে বিকল্প উপায়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাধানকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শুধু যুদ্ধই নয়, যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠনের বিষয়টিও এক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখতে হবে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অতীতের সামরিক হামলার অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে সিরিয়া সংকটে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি মন্তব্য করে এ এমপি বলেন, সিরিয়ায় বিমান হামলার পক্ষে যারা পার্লামেন্টে ভোট দিয়েছেন, আইসিস বা ডায়েশের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। আমার বিবৃতিতেও এটি আমি বলেছি। এই ভয়ানক জঙ্গি গোষ্ঠী নির্মূলের বিষয়ে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে এই কাজটি সম্ভব এবং ব্রিটেনের সামরিক অভিযান দ্বারা আদৌ এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব কি-না?
রুশনারা বলেন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে আড়াই লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আরও কয়েক মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। এখন বিমান হামলা করে যদি এই প্রাণহানির সংখ্যাই শুধু আরও বাড়ে তাতে লাভ হলো কী?
তিনি বলেন, এই সংঘাতের অবসান এবং আইসিস বা ডায়েশের নির্মূলের জন্য রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন সেখানে একটি গ্রহণযোগ্য সামরিক স্থলবাহিনীর উপস্থিতি। এর সঙ্গে থাকতে হবে মানবিক সাপোর্ট এবং যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন পরিকল্পনা।
সম্প্রতি সিরিয়ায় বিমান হামলার পক্ষে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে কোনো যুক্তি নেই দাবি করে রুশনারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কোনো যুক্তি নেই বলেই আমি এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছি। এই বিমান হামলায় একমাত্র মিত্রদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ ছাড়া আর কোনো ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি না। যৌথ বাহিনী সিরিয়ায় ইতোমধ্যে দুই হাজার সাতশ’ বিমান হামলা চালিয়েছে বলে কোনো কোনো রিপোর্ট থেকে জানা যায়। হামলা চালানোর মতো আর কোনো টার্গেটই নাকি অবশিষ্ট নেই। তাই এমন একটি পরিস্থিতিতে যথাযথ, গ্রহণযোগ্য এবং আস্থাভাজন স্থল অভিযান ছাড়া বিমান হামলা করে কোনো কিছু অর্জন সম্ভব নয়। আর এই স্থল অভিযানে বাস্তব কারণেই রাশিয়া এবং ইরানসহ অন্যান্য আর্ন্তজাতিক শক্তির অংশগ্রহণও দরকার। সিরিয়া নিয়ে সমন্বিত এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন রুশনারা।
বিমান হামলার পক্ষে সম্প্রতি পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবে রুশনারার দলেরই ৬৬ জন এমপি ভোট দিয়েছেন। এ বিষয়ে লেবার পার্টির উদীয়মান এ নেত্রী বলেন, ‘এটিই গণতন্ত্র’। প্রত্যেকেরই নিজের মত করে ভাবার স্বাধীনতা আছে। আমার ওই সহকর্মীরা হয়তো মনে করেছেন আইএস জঙ্গিদের বর্বরতার চূড়ান্ত পর্যায়ে বিমান হামলাই এই মুহূর্তে সঠিক পদক্ষেপ। এই মনে করার স্বাধীনতাও তাদের আছে।
প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন সিরিয়ায় বিমান হামলা ইস্যুতে পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতা ও রুশনারার দলের প্রধান জেরিমি করভিনকে ‘টেরোরিস্ট সিম্পেথাইজার’ বলে মন্তব্য করার প্রতিক্রিয়ায় দলীয় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন মন্তব্য মোটেই শোভা পায় না, মানানসইও নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রিপাবলিকান দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্র্রাম্পের সাম্প্রতিক দাবির বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখান রুশনারা। তিনি বলেন, এই মনমানসিকতার মানুষের স্থান বর্তমান আধুনিক বিশ্বে কোনোভাবেই হতে পারে না, ব্রিটেনে তো নয়ই।
রুশনারা বলেন, ট্রাম্প এই বক্তব্য দিয়ে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন যা বিপদজনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী তার এই মন্তব্য টেরোরিস্ট আইডলজির পালেই হাওয়া দেবে। ইসলাম বিদ্বেষ, ইহুদী বিদ্বেষ, বর্ণবাদ বা অন্য যে কোনো ধরনের ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে।
বাংলাদেশি-ব্রিটিশ এই এমপি বলেন, ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ায় এমন কোনো আচরণ বা ভাষা প্রয়োগের সুযোগ নেই একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বে। ট্রাম্প এমন এক সময় এই মন্তব্য করলেন যখন এ সপ্তাহে আমরা ‘রেইস রিলেশন্স অ্যাক্ট ১৯৬৫’ এর বার্ষিকী পালন করছি। বর্ণবাদ ও বৈষম্য যে আমাদের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ, ট্রাম্পের এই মন্তব্য এটিই আবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলো। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
এইচএ/