লন্ডন: ব্রিটেনের প্রবীণ রাজনৈতিক, অলপার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস কমিটির ভাইস চেয়ার, পার্বত্য চট্টগাম বিষয়ক কমিশনের কো-চেয়ার লর্ড এরিক এইভবারির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানানোর জন্যে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন প্রবীণ এই ব্রিটিশ রাজনীতিকের পরিবার।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেলে পূর্ব লন্ডনের মন্টিফিউরি সেন্টারে এইভবারির স্মরণে ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর স্যেকুলার বাংলাদেশ (আইএফএসবি) আয়োজিত শোক সভায় প্রেরিত এক বার্তায় পরিবারের পক্ষে তাঁর মেয়ে ভিক্টোরিয়া লাববক এই কৃতজ্ঞতা জানান।
আইএফএসবি’র কেন্দ্রীয় নেতা আনসার আহমেদ উল্লা’র সভাপতিত্বে ও যুক্তরাজ্য কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জামাল আহমেদ খানের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই শোকসভার প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ বিষয়ক কর্মকাণ্ডে লর্ড এইভবারির ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা, প্রবীণ রাজনীতিক সুলতান শরীফ।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা, আজিজ চৌধুরী, মতিয়ার চৌধুরী, কাউন্সিলার রহিমা রহমান, সাংবাদিক শাহ মোস্তাফিজুর রহমান বেলাল, মহিলা নেত্রী বেগম হোসনে আরা মতিন, মিয়া আখতার হোসেন সানু, সাংবাদিক আহাদ চৌধুরী বাবু, কবি মুজিবুল হক মনি, কমিউনিটি নেতা মুজিবুর রহমান জসিম, রুবি হক, এনামুল হক, যুবনেতা সরোয়ার কবির, ছাত্রনেতা সজিব ভুইয়া ও শাহ ফয়েজ প্রমুখ,
কৃতজ্ঞতা বার্তায় ভিক্টোরিয়া নিজে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পারায় দু:খ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশী কমিউনিটির সাথে লর্ড এইভবারির সম্পর্ক ও কাজের জন্যে পরিবার হিসেবে আমরা খুবই গর্বিত, আমাদের এই বার্তাটি শোকসভায় আগতদের কাছে পৌঁছে দিলে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো। ’
বার্তায় ভিক্টোরিয়া আরও বলেন, মাঝে মাঝে এরিকের কাজগুলো ফাইলিং করতে সহযোগিতা করার চেষ্টা কালে আমি দেখেছি বাংলাদেশি কমিউনিটি ও বাংলাদেশ সম্পর্কে তার উপলব্ধি কত গভীর ছিলো’। অন্যান্যরাও এরিকের মত এই বিষয়গুলো গভীর ভাবে উপলদ্ধি করবেন ও তাঁর কাজ এগিয়ে নেবেন, বার্তায় এইভবারি কন্যা এমনটিই আশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবার প্রতি বাংলাদেশি কমিউনিটির এত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সত্যিই আমরা কৃতজ্ঞ’। ভিক্টোরিয়া ছাড়াও লিখিত বার্তা পাঠিয়ে এইভবারিকে স্মরণ করেন হিউম্যানিটারিয়ান এইড রিলিফ ট্রাস্টের প্রেসিডেন্ট ব্যারোনেস কেরোলিন কক্স ও লর্ড কার্লাইল।
অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক সুলতান শরীফ প্রয়াত লর্ড এরিক এইভবারির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের একজন প্রকৃত বন্ধু ছিলেন লর্ড এইভবারি।
যে চেতনা নিয়ে জাতির জনকের নেতৃত্বে বাঙালি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলো সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে এইভবারির ছিলো দৃঢ় অবস্থান।
একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার আদায়ের আন্দোলনে প্রথম থেকেই এইভবারি সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে এসেছেন, এমন মন্তব্য করে সৈয়দ আনাস পাশা বলেন, মৃত্যুর আগে কিছু সময় বিভিন্ন ভাবে তাঁকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে যুদ্ধাপরাধী সমর্থক লবি। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে প্রবীণ এই ব্রিটিশ রাজনৈতিক মন্তব্য করেছেন সংবাদ মাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে বিভিন্ন সময় এমন ঐ গোষ্ঠী এমন প্রোপাগান্ডা করলে বাংলানিউজের মাধ্যমে তিনি এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বাংলানিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সাক্ষাতকার দিতে গেলে এইভবারি দৃঢ়ভাবে ঐসব প্রোপাগান্ডা অস্বীকার করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন আনাস পাশা।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রাদায়ের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন লর্ড এরিক এইভবারি, শোকসভার সভাপতি মানবাধিকার কর্মী আনসার আহমেদ উল্লাহ তাঁর বক্তব্যে এমনই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যখনই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রাদায়ের উপর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির আঘাত এসেছে, তখনই গর্জে উঠেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই নেতা।
অনুষ্ঠানে লর্ড এইভবারি স্মরণে খোলা একটি শোক বইয়ে সবাই স্বাক্ষর করেন। শোক বইটি উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এইভবারি পরিবারের কাছে।
উল্লেখ্য, ১৩ই ফেব্রয়ারি শনিবার ৮৭ বছর বয়সে লন্ডনের নিজ বাসভবনে জীবনাবসান ঘটে প্রবীণ ব্রিটিশ রাজনীতিক লর্ড এইভবারির। দীর্ঘদিন যাবত তিনি ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন খ্যাতিমান মানবাধিকার নেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন প্রবীণ এই রাজনীতিক। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ছিলো আলাদা একটি টান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্রিটেনে ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন নামক একটি সংগঠনের চেয়ারের দায়িত্ব পালন করে গেছেন লর্ড এইভবারি। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিশনের চেয়ারের দায়িত্বেও ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এই মানবাধিকার নেতা। সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালসহ অন্যান্যরা ছিলেন এই কমিশনের সদস্য। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি ঘটনা ব্যাপক পীড়া দিত প্রবীণ রাজনীতিক এইভবারিকে। রাজনীতিকে পার্লামেন্ট কেন্দ্রিক করতে জাতীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রায় প্রতি বছরই লন্ডনে হাউস অফ লর্ডসে ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এইভবারি আয়োজন করতেন বাংলাদেশ বিষয়ক সেমিনার। এইসব সেমিনারে সরকার ও বিরোধী দলীয় নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এক টেবিলে বসানোর চেষ্টা করতেন আজীবন গণতন্ত্রের পূজারী প্রবীণ এই রাজনীতিক। বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলীয় রাজনীতিকরা লন্ডন আসলে অনেকেই সাক্ষাত করতেন মানবাধিকার আন্দোলনের অভিভাবকতুল্য লর্ড এইভবারির সাথে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাম্প্রদায়িকতা, সংখ্যালঘু নিরযাতনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন সময় বাংলানিউজের সাথে একান্তে কথা বলেছেন অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপের ভাইস চেয়ার লর্ড এইভবারি। বাংলানিউজে প্রকাশিত তাঁর সম্পর্কিত অনেক নিউজ নিজ ব্লগেও বিভিন্ন সময় প্রচার করেছেন তিনি। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার কারণে বাংলাদেশের সাংবাদিক, রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীসহ ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিত ছিলেন ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডসের প্রবীণ এই সদস্য।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালনকারী লর্ড সদস্য ছিলেন লর্ড এইভবারি। ১৯৬০ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে (লিবডেম) যোগদানের পর ৬২ সালে গ্রেটার লন্ডনের অরপিংটন এলাকার উপনির্বাচনে তিনি প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ৭৮৫৫ ভোটের ব্যবধানে বিজয় ছিনিয়ে আনায় ঐ সময় তিনি ‘অরপিংটন ম্যান’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান। হাউস অব লর্ডসের সদস্য মনোনীত হওয়ার এক বছর আগে ১৯৭০ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হন আলোচিত এই লিবডেম দলীয় রাজনীতিক। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাউস অব লর্ডসের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
আরআই