লন্ডন: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (অব.) ইয়েন কার্ডোজো বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে অনেকেই অনেকভাবে মূল্যায়ন করেন। কেউ বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন, কেউ বলেন, ভারতের সাহায্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে তার সম্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসব মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আরেক কিংবদন্তী ভারতীয় সেনানায়ক প্রয়াত লে. জে. ফারিডন বিলিমোরিয়ার ওপর তার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে যোগ দিতে জেনারেল ইয়েন কার্ডোজো বর্তমানে সস্ত্রীক লন্ডন সফর করছেন। স্বাধীনতা ট্রাস্ট ও কারী লাইফ ম্যাগাজিনের সহায়তায় এ সংবর্ধনা দেয় হাইকমিশন।
ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার খোন্দকার মোহাম্মদ তালহা স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন সিলেট অঞ্চলে যুদ্ধরত ভারতীয় জেনারেল কার্ডোজো। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গিয়ে সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে স্মরণ করেন তিনি।
তিনি বলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে এই বীর সেনানায়ক যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি হারিয়েছিলেন তার শরীরের একটি অঙ্গ।
কর্নেল তাহেরকে জিয়াউর রহমানের ফাঁসি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে কার্ডোজো বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আমলে আদালতের রায়ে ওই বিচার অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করছি’।
বাংলাদেশের নিজের শরীরেরও একটি অঙ্গ হারানো জেনারেল কার্ডোজো সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ইতিহাসও বর্ণণা করেন। সিলেট অঞ্চলের পুরো পাকিস্তানি গ্যারিসনে ৩ জন ব্রিগেডিয়ার, ১ জন কর্নেল, ১শ’৭ জন অফিসার, ২শ’ ১৯ জন জিসিও, ৬ হাজার ১শ’ ৯০ জন সৈন্য এবং ৩৯ জন বেসামরিক লোক ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বর সকালে তাদের নিরস্ত্র করে নিয়ে যাওয়া হয়।
ওই আত্মসমর্পণ শেষে ভারতীয় বাহিনী সিলেট শহরে ঢোকার মুহূর্তে মাইন বিস্ফোরণে জেনারেল কার্ডোজো তার একটি পা হারান।
তিনি জানান, ৭ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতীয় বাহিনীর ১ জন অফিসার, ২ জন জিসিও এবং অন্যান্য পদমর্যাদার ১১ জন সদস্য সিলেট অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের জীবন দান করেন। নিজেসহ তিন অফিসার ও বিভিন্ন পদমর্যাদার আরও ৩৬ সদস্য আহত হন। ৬/৭ জন অফিসার, ১০/১৫ জন জিসিও এবং ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ সৈন্য নিয়ে গঠিত ছিলো সিলেট অঞ্চলের ভারতীয় ব্যাটালিয়ন।
ভারতীয় বাহিনীর ৪/৫ টি গোর্খা রাইফেলস গ্রুপ (ফ্রন্টিয়ার ফোর্স) তার নেতৃত্বে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছে জানান জেনারেল কার্ডোজো। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, আটগ্রাম ও গাজীপুর টি-গার্ডেন যুদ্ধে কিভাবে কোম্পানি কমান্ডারসহ পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট গ্রুপকে তারা পরাস্ত করেছিলেন তারও বর্ণনা দেন তিনি।
প্রয়াত লে. জেনারেল বিলিমোরিয়ার সন্তান ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডস সদস্য লর্ড কিরন বিলিমোরিয়াও তার বাবার স্মৃতিচারণ করেন অনুষ্ঠানে। তিনি জানান, কিশোর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নে কিভাবে বিভোর ছিলো তার বাবার কাছে সেই গল্প শুনেছেন তিনি। বাবার উদ্ধৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধাদের সাহসী গল্পের কথাও শোনান তিনি।
একজন কিশোর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার জন্যে নিজের জীবন দানসহ যেকোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল- বাবার কাছে শোনা এমন গল্প বলতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনও করেন।
লর্ড কিরনের বাবা প্রয়াত লে. জে. ফারিডন বিলিমোরিয়া ছিলেন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান আর্মির জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ২/৫ গোর্খা রাইফেলসের নেতৃত্ব দেন তিনি।
সমাপনী বক্তব্যে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার খোন্দকার মোহাম্মদ তালহা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে ধন্যবাদ জানান জেনারেল কার্ডোজোকে। তিনি জেনারেল ও তার স্ত্রী প্রিসিলা কার্ডোজোর হাতে তুলে দেন উপহার ও ফুল। মিনিস্টার প্রেস নাদিম কাদির তার লেখা ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’ তুলে দেন জেনারেল দম্পতির হাতে, যে বইটিতে রয়েছে তার বাবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল কাদেরের বীরত্বের কথা।
অনুষ্ঠানে লন্ডন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নঈমুদ্দিন রিয়াজ, ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুর উদ্দিন আহমদ, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী হোসনা মতিন, মেহের নিগার চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, লোকমান হোসেইন, কয়সর সৈয়দ ও আবুল কাশেম খান, জামাল আহমেদ খান, সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন, মতিয়ার চৌধুরী, তানবীর আহমেদ, হেফাজুল করিম রাকিব, শাহ মোস্তাফিজুর রহমান বেলাল, আব্দুর রশীদ, আনসার আহমেদ উল্লা ও জুলি বেগম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৬
এসএপি/এএসআর