লন্ডন: ঔপনিবেশিক আমলে পাঁচটি নারকীয় নৃশংসতার ঘটনা ঘটালেও ব্রিটিশরা এখনও তাদের সাম্রাজ্য ও ঔপনিবেশিক শাসনামল নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত ইউগভ পোল (YouGov poll) নামে একটি সংস্থার জরিপ প্রতিবেদনে এমনটাই জানা যায়।
জরিপের তথ্য মতে, এক সময়ের ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে ব্রিটিশদের ইতিহাস রয়েছে। এ নিয়ে গর্ব অনুভব করেন প্রায় ৪৪ শতাংশ ব্রিটিশ। নিজেদের এই ইতিহাসের কারণে অনুশোচনা রয়েছে ২১ শতাংশ ব্রিটিশের। আর ৪৩ শতাংশ মনে করেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশ ভালো ছিলো। ১৯ শতাংশের এর মতে-এটি মোটেই ভালো ছিলো না।
১৯২২ সালে ঔপেনিবেশিক শাসনামলের স্বর্ণযুগে সারা বিশ্বের স্থলভাগের এক চতুর্থাংশ এবং জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনাধীন।
সাম্রাজ্যের প্রবক্তারা যদিও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্বের বিভিন্ন অংশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সময় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু সমালোচকদের মতে, সময়টি ছিলো গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নির্যাতনের। ওই সময় ব্রিটিশ শাষকগোষ্ঠী ঔপনিবেশে ঘটিয়েছে দুনিয়া কাঁপানো পাঁচ-পাঁচটি নৃশংসতা। যার তিনটিই ঘটেছে অভিবক্ত ভারতে।
ভারতে ঘটে যাওয়া তিন নৃশংসতার একটি দুর্ভিক্ষ। যার কারণে তখন জীবন দিতে হয়েছিলো ১২ থেকে ২৯ মিলিয়ন ভারতীয়কে। যার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিলো প্রায় ৪০ লাখের মতো।
ভারতে উৎপাদিত লাখ-লাখ টন গম ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেওয়ায় ওই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভারতের জনগণের কথা চিন্তা না করে গম ও খাদ্যশষ্য ব্রিটিশ সৈন্য ও গ্রিসের মত দেশগুলোর জন্য পাঠানো হলে পুরো বাংলায় নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। অনাহারে মৃত্যু হয় ৪০ লাখ বাঙালির।
১৯৪৩ সালের বাংলার এই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে চার্চিলের মন্তব্য ছিলো- 'আমি ভারতীয়দের ঘৃণা করি, ওরা নিকৃষ্ট ধর্মের নিকৃষ্ট মানুষ। খরগোশের মতো প্রজনন এদের। নিজেদের দোষেই এই দুর্ভিক্ষ এনেছে তারা। '
এই দুর্ভিক্ষ ছাড়াও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত বিভাগ ও অমৃতসরের জালিওয়ানবাগ হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আরও দুই নৃশংসতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিওয়ানবাগ গার্ডেনে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে গুলি চালিয়ে ৩৭৯ থেকে ১ হাজার প্রতিবাদকারীকে হত্যা করেছিলো ব্রিটিশ গোর্কা সৈন্যরা।
১০ মিনিট স্থায়ী ওই গুলিবর্ষণে তখন আহত হয়েছিলেন আরও ১১শ’ মানুষ। ওই আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার ডাইয়ার, যিনি পরবর্তীতে ব্রিটিশদের কাছে হিরো হিসেবে প্রশংসিত হন। তাকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় ২৬ হাজার পাউন্ড।
ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ ইতিহাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আরেক নৃশংসতা। মধ্যাহ্ন আহার করতে-করতে কলমের আচরে ভারত ভাগের নকশা করেছিলেন সিরিল রেডক্লিফ। ধর্মের ভিত্তিতে করা এই ভারত ভাগের কারণে ভারতীয় মুসলমান ও পাকিস্তানি হিন্দু মিলে প্রায় ১ কোটি মানুষ তখন হয়েছিলো বাস্তুহারা। ফলে শুরু হয়েছিলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সেই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ।
ভারতে এই তিন নৃশংসতা ছাড়াও আফ্রিকার বোয়ার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প (Boer concentration camps) এবং কেনিয়ার মাউ-মাউ বিদ্রোহ দমন ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আরও দুই নৃশংসতার ঘটনা।
১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী দ্বিতীয় বোয়ার যুদ্ধের সময় ১ লাখ ৭ হাজার (বোয়ার জনসংখ্যার এক ষষ্ঠমাংশ) মানুষ, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। তাদের আটক করে রাখা হয় ক্যাম্পে। গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন যাপনকালে খাদ্য সংকট ও বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে ২৭ হাজার ৯২৭ জন বোয়ার নাগরিকসহ মারা যান অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ।
১৯৫১ থেকে ১৯৬০ সাল সময়কালীন কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহ (Mau Mau Uprising) দমন কালে হাজারও কেনিয়ান নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে ব্রিটিশ শাষকদের বিরুদ্ধে।
এসব নৃশংসতার ঘটনায় সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
টিআই