যখন জার্মানিতে আসি তখন আমার বড় সন্তানের বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বৎসর। দেশে সে দুই বৎসর কিন্ডারগার্টেনে গিয়েছিল।
বাংলাদেশে আমার সন্তান মায়ের এবং তার চারপাশের সবার আদরে হেসে-খেলে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে, যখন কিন্ডারগার্টেনে দেবার সময় হল, তখন ছন্দপতন হলো।
আমি থাকতাম ঢাকার রামপুরার বনশ্রীতে। তাকে ওখানেই একটা কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেয়া হল। প্রথমদিন তো সে কিছুতেই শ্রেণিকক্ষে ঢুকবে না। ওরই বা দোষ কি? ছোট ছোট সব শ্রেণিকক্ষের একেকটিতে ২৫/৩০ জন করে শিশু গাদাগাদি করে বসে আছে। অনেক জোরজবরদস্তি করে তাকে ঢুকিয়ে দিলাম, দরজাটা বন্ধ করে দেয়া হল। সে শুধু কাঁদছে আর কাঁদছেই।
একদিকে ও কেঁদেই যাচ্ছে, আর অন্যদিকে শিক্ষক বাচ্চাদের অক্ষরদান করছেন। মনে হয়, শুধু আমার সন্তানই নয়, প্রতিটি মায়ের সন্তানেরই কিন্ডারগার্টেনে শুরুটা এভাবেই হয়। এভাবেই চলল কয়েকদিন। রীতিমত ধস্তাধস্তি করে তাকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে আসতাম। যাকে কত আদরে বড় করছি, গায়ে ফুলের টোকাটাও লাগতে দেইনি। কিন্তু তারপর থেকে তাকে কিন্ডারগার্টেনে যেতে অনিচ্ছার কারণে মাঝে মাঝেই বকতে শুরু করলাম।
যে শিশুটি কিন্ডারগার্টেনেই যেতে চায় না, প্রথম দিন থেকেই তার কোমল মাথায় আর মনে লেখাপড়ার বোঝা চাপতে শুরু করল। গাদাগাদা হোম ওয়ার্ক বাড়িতে দিয়ে দেওয়া হত। মনে হত ওগুলো শেখানো সব আমার বা অভিভাবকের দায়িত্ব!
যা হোক, আমার দায়িত্ব আমি শুরু করলাম। অক্ষরদান আর হোমওয়ার্ক করাতে গিয়ে আমার ওই আদরের শিশু আমার কাছে কত বকাই না খেয়েছে। হোম ওয়ার্ক শেষ না হলে, ক্লাসে ভাল না করলে এটা দেবো না ওটা দেবো না, এইসব বলে তার সখের বায়না আর আবদারগুলো প্রতিহত করেছি বার বার।
আমাদের দেশে আমার সন্তানের মত প্রায় সব মায়ের সন্তানেরই তো লেখাপড়ার সূচনা এভাবেই হয়, শিশুদের নরম কোমল মনে একরকম মানসিক অত্যাচারের ভিতর দিয়ে। এতে করে শিশুদের স্বাভাবিক মনের বিকাশে আর বেড়ে ওঠার উপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ে আমরা কেউ তা বোঝার চেষ্টা করি না।
জার্মানিতে আসার পর এখানকার লেখাপড়ার ধরন দেখে আমি শুধু মুগ্ধই হইনি, অবাক হয়েছি।
এখানে শিশুদের কিন্ডারগার্টেনের জীবনটা ছোট একটা বদ্ধ কক্ষে অক্ষরদান, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ দিয়ে শুরু হয় না। অন্যরকম একটা পরিবেশে শুরু হয়। অনেক বড় পরিসরে কিন্ডারগার্টেনের সম্মুখে শিশুদের খেলাধুলার জন্য খোলা পার্ক থাকে, অনেক বড় বাড়িটার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শুধু দৌড়-ঝাঁপ, খেলাধুলা আর আনন্দ। ছোট ছোট বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, গল্প, খেলা আরও কত কি! শিক্ষকদের সাথে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, কখনো বাসে করে, কখনো ট্রেনে করে বিভিন্ন পার্কে, প্রকৃতির মাঝে, গাছ গাছালির মাঝে, পশু-পাখির কাছে, ফুলের বাগানে কত কি যে আনন্দ সেখানে! শিক্ষা খুবই মজার ব্যাপার, যন্ত্রণার কিছু নেই। কোনো বাচ্চার ঘুম এলে, বিছানা বালিশও আছে। শিশুরা বাসায় আসবার কথা ভুলে যায়।
জার্মানিতে শিশুরা কিন্ডারগার্টেনে কোনো লেখাপড়াই করে না, শুধু রং পেন্সিলের খেলা, ইচ্ছাখুশি মত নিজের চিন্তা ভাবনা থেকে আঁকাঝুকা করে, এতে তাদের মনের সুন্দর বিকাশ ঘটে। ধরে বেঁধে গণনা শেখানো লাগে না। লেগো ও পাজেল টাইপের বিভিন্ন রকম খেলনা থাকে, যেগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে যেমন বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, আবার গণনাও শিখে যায়, আবার সৃজনশীল চিন্তা ভাবনাও মাথায় খেলা করে।
এখানে বিভিন্ন দেশের মানুষের বসবাসের কারণে দেশ-বিদেশের সব শিশু একে অপরের সাথে বন্ধুতা শেখে, জানতে পারে বিভিন্ন দেশের মানুষের কালচার, যা এই শিশুকাল থেকেই মনের দরজাকে প্রসারিত করতে শুরু করে। লেখা-পড়া, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ শুরু হয় কিন্ডারগার্টেনের ধাপ পার হলে স্কুলে। প্রথম শ্রেণি থেকে, যখন বাচ্চাদের স্কুল জীবন শুরু হয়।
আমার দুই ছেলের মধ্যে বড় জন এগার শ্রেণিতে পড়ে, আর ছোটজন অষ্টম শ্রেণিতে। সেই প্রথম শ্রেণি থেকে এ পর্যন্ত আমি তাদের কখনো পড়তে বসতে বলিনি আর কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট শিক্ষক এসব তো দূরের কথা। আমার নিজের সাহায্যও কোনদিন বাচ্চাদের লাগেনি। এটা শুধু আমার কথা নয়, জার্মান প্রবাসি প্রায় সব বাবা-মায়ের এই একই কথা। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো বাচ্চার ম্যাথমেটিক্সে সাহায্য দরকার হয়, তার সংখ্যাও খুব কম এবং তাও আবার অষ্টম শ্রেণির পরে। স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা এতটাই সুন্দর যে, লেখাপড়া স্কুলের কাজ আর তা স্কুলেই শেষ করে আসে। বাড়ির জন্য যে হোম ওয়ার্কটা থাকে তা ছাত্র-ছাত্রীরা এক ফুঁতেই শেষ করে ফেলে। স্কুলে শিক্ষক এভাবেই শিখিয়ে থাকে। আমাদের বাঙালিদের বেশীর ভাগ বাচ্চাই অত্যন্ত ব্রিলিয়্যান্ট এবং গ্লোরিয়াস রেজাল্ট করে ভাল ভাল ইউনিভার্সিটি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে।
আমাদের দেশে যেমন ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর পেছনে প্রায় সব পিতা-মাতা তাদের নিজেদের জীবনটা বলতে গেলে একরকম বিসর্জন দিয়ে দেয়, তেমন সমস্যায় এখানে পড়তে হয় না। পিতা-মাতার খুব বেশী অর্থেরও প্রয়োজন পড়ে না।
এখানে যেন রূপকথার গল্প। দশ ক্লাসের পরে যদি কেউ লেখাপড়া নাও করে তাতেও সে না খেয়ে মরবে না, যে কোন ভাল কিছু করে পেট চালাবার ক্ষমতা এর মধ্যেই সে অর্জন করে ফেলে। আমাদের দেশের মত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা না হলে পেটে ভাত জুটবে না তেমনটা নয় এখানে। সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে স্কুলের দশম শ্রেণি পর্যন্ত অর্থাৎ একটা মানুষের শিশুকাল থেকে আঠার বৎসর বয়সের মধ্যেই একটা মানুষ সত্যিকারের মানুষ রূপে গড়ে ওঠে। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় আর এই সত্যিকারের মানুষ করে গড়ে তোলার কাজটি করেন জার্মানির শিক্ষকমণ্ডলী। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি সব রকম মানবিক শিক্ষা স্কুলেই দেওয়া হয়।
কনা ইসলাম: জার্মান প্রবাসী সঙ্গীতশিল্পী।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৭
এমপি/জেডএম