সকাল ছয়টায় ঘুম ভেঙে আমার শোবার ঘরের বড় কাচের দরজা-জানালার দিকে চোখ পড়তেই দেখি বাইরের গাছের ডাল-পালা, প্রতিবেশির বাড়ির টালির ছাদ, সব সাদা বরফের চাদরে ঢেকে আছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।
হারিয়ে গেলাম উঠোনের মিষ্টি রোদে, নানীর হাতের মজাদার রসে ভেজানো চিতই পিঠার থালাতে আর গ্লাস ভর্তি মুড়ি ভেজানো খেজুরের রসে। কবিগুরু কি আর সাধে লিখেছিলেন- ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি’। শুধু কি রসে ভিজানো চিতই পিঠা আর খেজুরের রস?
জার্মানির তুষারপাতে মন পড়ে দ্বিজেন্দ্র লাল রায় লিখেছেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’। এইসব মহা মনীষীরা দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর কত সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাতৃভূমিকেই পৃথিবীর রানী করে গেছেন।
আসলেই তাই। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর গাছ-গাছালি, রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট যেখানেই তাকানো যায় সবখানেই যত্নের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। চারপাশের গাছ-পালা, ফুল সব অত্যন্ত যত্ন করে কেটেছেঁটে সাজানো। তবুও আমার মতো সকল প্রবাসীদের মন চলে যায় অযত্নে পড়ে থাকা বাংলার ধানের ক্ষেতে, ধুলো মাখা গাছের পাতায়, সরিষা ফুলের মাঠে, নদীর ধারের কাশবনে, বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে, অযত্নে বেড়ে ওঠা হাসনাহেনা, বেলি, গাঁদা আর পুকুর ভরা শাপলা ফুলে আর লাল পলাশের বনে।
সব যেন মায়ায় ভরা যা ইউরোপ-আমেরিকার সাজানো পাম গাছের সারিতে নেই, আছে আমার বাড়ির পুকুর পাড়ের সরু রাস্তার দুই পাশের সেই নারিকেল, সুপারির সারিতে। এখানে সাজানো গোলাপের বাগানে গেলে চোখে শান্তি লাগলেও মন ভরে না, কাছে গিয়ে যখন দেখি একটা গোলাপেও কোন সুবাস দেশের ঘ্রাণের মতো নেই।
এখানকার বাড়িগুলো কত সৌখিন গাছে গাছে আর ফুলে ফুলে সাজানো। কিন্তু বাংলার মায়াভরা গ্রামের বাড়ির পুঁই আর লাউ এর মাচায় চড়ুই পাখি, শালিক আর প্রজাপতির খেলার দৃশ্য অনেক বেশি মনোহরা। লাউয়ের মাচার কথা উল্লেখ করে আমার বাংলার গান ও খাবারের কথা মনে পড়ে গেল। আহ্ ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’।
সারা ইউরোপ-আমেরিকায় আমার মনে হয় একটি মাত্র শাক আছে, যাকে ইস্পিনাট বলে, অনেকটা পালং শাকের মতো। এছাড়া আর কোন শাক আমার চোখে পড়ে নাই। পুঁই, পালং, লাল শাক, ডাটা শাক, কলমি শাক, কচু শাক ইত্যাদি বাংলায় যেন শাক-সব্জির ভাণ্ডার। আমি হলফ করে বলতে পারি বাংলার মাটির যে স্বাদ তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
এখানে দোকানে দোকানে কত ফলের সম্ভার কিন্তু বাংলার বরই, পেঁপে, পেয়ারা, আমড়া, আম, লিচুর মত কোথাও কি আছে? এখানে দুই পাড় বাঁধানো নদীর পাড়ে গেলে মন একটুও উদাস হয় না, যেমন পাড় ভাঙা মধুমতির চরে গেলে হয়। এখানে রাতে শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বড় চাঁদ দেখা যায় কিন্তু সেই চাঁদের আলোকে একটুও মায়াবী জ্যোৎস্না বলে মনে হয় না, যেমন মনে হয় বাংলার গাঁয়ের উঠোনে জ্যোৎস্না রাতের চাঁদকে আর বাড়ির ছাদের চাঁদের আলোকে।
আমার মতো সব প্রবাসীর মন ক্ষণে ক্ষণে চলে যায় বাংলায়, প্রিয় ভূমিতে- সবাই একই সুরে গেয়ে ওঠে-আমার মন চলে যায় বাংলাদেশের সুদূর একটি গাঁয়ে, যেথায় শ্যামল মাঠ, ধান-কাউনে দুলছে বায়ে বায়ে। কথাগুলো বড় বেশি মনে পড়ছে, এই শীতে, ধবল তুষারের হিমশীতল নৈঃশব্দের রাজ্যে। মনে হয় সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের চেয়ে বহুদূরের এক শূন্য রূপকথার দেশে আছি। শুভ্র তুষারের আদিঅন্তহীন সীমান্তে বার বার মনে পড়ছে লাল-সবুজের কথা, প্রিয় বাংলাদেশের কথা।
কনা ইসলাম; জার্মান প্রবাসী লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৭
এমপি/এমজেএফ