মালয়েশিয়া থেকে ফিরে: সকালে চোখ মুঁদে বাজেট-ইন হোটেলের ছোট জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তায় তাকালে বোঝার উপায় নেই এ দেশটা কোন জাতি গোষ্ঠীর।
কুয়ালালামপুরের ব্যাস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা বুকিত বিনতাং।
তবে হরেক জাতি থাকলেও সবাইকে নিয়ে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনের কথা ভাবে মালয়েশিয়া। পথে চলতে বাস স্টপেজ, ট্রেন স্টেশন, পাতাল রাস্তা বা সরকারি কোনো স্থাপনার সামনে চোখে পড়বে বড় একটি ইংরেজি ‘ওয়ান’ সংখ্যার প্রতীক। আর ‘ওয়ান’ এ মালয়েশিয়ার পতাকা। এটিই হচ্ছে ‘সাতু মালয়েশিয়া’ বা ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ স্লোগানের প্রতীক। মালয়ী ‘সাতু’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘এক’।
গত মে মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ অর্থাৎ জাতীয় ঐক্য বা ঐক্যবদ্ধ মালয়েশিয়া গড়ার স্লোগান বড়ো হয়ে উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী নজিব আব্দুর রাজ্জাকের দল উমনো (ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন) ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ স্লোগানকে পুঁজি করেই পার হয়েছে নির্বাচনের কঠিন পরীক্ষা। ১৯৫৭ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় সরকার গঠন করে এসেছে উমনো। জাতি পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতির যে সমালোচনা ছিল দলটির বিরুদ্ধে তাকে পাশ কাটিয়ে দাঁড় করিয়েছে ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ কনসেপ্ট।
ওয়ান মানে সবার এক দেশ এবং সেটি হবে এক নম্বর। দেশটিকে সবাই মিলে এক নম্বরে নিয়ে যাওয়ার এই আবেদন অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে মালয়ি জনগণের কাছে।
তিন লাখ ২৯ হাজার ৮৪৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ ভূখণ্ড কোনো একক জাতির রাষ্ট্র নয়। সর্বশেষ ২০১০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশটির জনসংখ্যা দুই কোটি ৮৩ লাখ। এর মধ্যে ৯১ দশমিক আট শতাংশ মালয়েশিয়ার নাগরিক। আট দশমিক দুই শতাংশ লোক এখানে ঘুরতে বা জীবিকার তাগিদে রয়েছে।
এখানে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (৫০ দশমিক চার শতাংশ) মালয়। জনসংখ্যার মোট ১১ শতাংশ রয়েছে সাবাহ ও সারওয়াক রাজ্যের ভূমিপুত্র (সন অব দ্যা সয়েল) বা মালয়েশিয়ার আদিবাসীরা। এই ৬১ দশমিক চার শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চীনা বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ানের সংখ্যা ২৩ দশমিক সাত শতাংশ।
অন্যদিকে, হিন্দু ধর্মের অনুসারী ভারতীয় তামিল বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান রয়েছেন সাত দশমিক এক শতাংশ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত তেরটি রাজ্য ও তিনটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বিশিষ্ট দেশ মালয়েশিয়া। চীন সাগরের দক্ষিণে অবস্থানরত মালয়েশিয়ার সঙ্গে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই ও ফিলিপাইনের সীমান্ত রয়েছে। আর তাই এসব দেশের জনগণও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। এছাড়া বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছে এদেশে। যারা কিনা শ্রম দিয়ে আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ায় অবদান রেখে যাচ্ছে।
বহু নৃ-গোষ্ঠীর আবাসস্থল হওয়ায় মালয়েশিয়ার সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈচিত্র্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আর এই সব বৈচিত্র্যকে এক করে এক নম্বর দেশ গড়তেই কাজ করছে দেশটির সরকার। যে দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের জনগণের মধ্যেও।
মালয়েশিয়া অবস্থানের প্রথম তিনদিন চেরাসের যে ব্লকে (ভবনে) আমি ছিলাম, সেটি কিছুটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রাবাসের মতো। বারান্দা হয়ে সবগুলো কনডোতে (বাসায়) প্রবেশ করতে হয়। একটি ফ্লোরে প্রায় ২১টি করে কনডো রয়েছে।
বারান্দা ধরে হাঁটার সময় চোখে পড়ে কোনো বাসার সামনে গণেশ বা কালীর মূর্তি। ধূঁপের গন্ধ। ওই সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব দীপাবলী আসন্ন ছিল। নভেম্বরের ২ তারিখে দীপাবলী। সারাদিন-রাত আতশবাজি আর পটকার আওয়াজ।
ব্লকে রয়েছে থাই, ইন্দোনেশিয়ান আর চায়নিজদেরও বাস। চায়নিজদের বাসার সামনে ঝুলছে রঙ্গিন কাগজ কেটে সুন্দর করে বানানো বিভিন্ন আকর্ষনীয় ক্যালিওগ্রাফি, যেটা সব সময় চায়নিজদের ঐতিহ্য বহন করে।
ভিন্ন ধর্ম আর জাতির লোকদের বাস থাকলেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তাদের মধ্যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে দেয় না। বরং ২ নভেম্বরের দীপাবলীর উৎসবে অংশ নেয় মালয়ি আর চায়নিজরাও।
মূল তিনটি জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে পোশাকেও। তবে আঁটসাট হাফপ্যান্ট পড়া চায়নিজ মেয়েদের সঙ্গে বাসে বা ট্রেনে হিজাব পড়া মালয়ি মেয়েরাও এক খুঁটি ধরে দাঁড়াতে বা পাশের সিটে বসতে কখনো অস্বস্তি বোধ করে না।
১৬ নভেম্বর সালামজায়া থেকে কেএলটিসিতে আসার সময় এলআরটিতে চোখে পড়ে এই ভাতৃত্ববোধের দৃষ্টান্ত। পাশাপাশি বসার দৃশ্য মেলে তিন জাতির তিন নারীর তিন ধরনের পোশাকে।
তবে কিছু বৈষম্য রয়েছে ঠিকই। মালয়িদের তুলনায় কিছু কম সুবিধা পেয়ে থাকে অন্য জাতিগোষ্ঠী। তবে উন্নত মালয়েশিয়া গড়ার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে রয়েছে প্রবল স্বদেশ প্রেম। যে কারণে জাতিগত বিভেদের বিষয়টি মাথা চাড়া দিতে পারে না।
মালয়েশিয়ার স্বাধীনতায় অবদান রয়েছে এ তিন জাতিরই। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ ও উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা বর্তমান মালয়েশিয়া অঞ্চলে উপনিবেশ এবং আশ্রিত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। একে বলা হতো ব্রিটিশ মালয়। ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপান ধীরে ধীরে মালয়েশিয়া দখল করতে থাকে। ১৯৪৮ সালে মালয় উপদ্বীপে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে মালয় ফেডারেশন গঠিত হয় যা ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
সিঙ্গাপুরের ব্রিটিশ উপনিবেশ ও পূর্ব মালয়েশিয়ান রাজ্য ১৯৬৩ সালে ফেডারেশনে যুক্ত হয়, আর তখনই মালয়েশিয়া স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার বলা হয় দেশটির সাবেক (দীর্ঘ মেয়াদি: ১৯৮১-২০০৩) প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদকে। তার নেতৃত্বে মালয়েশিয়া বর্তমান বিশ্বের একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
২২ বছরের শাসনামলে ড. মাহাথির গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন, নারীর ক্ষমতায়ন ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করেছিলেন। এখানে কোনো জাতি গোষ্ঠীর লোকই এক বাক্যে মাহাথিরকে সালাম জানাতে কার্পণ্য করে না।
ভারতীয়, মালয় ও চৈনিকদের সহাবস্থানের বিষয়টিকে এ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রাজ্জাক থেকে ড. মাহাথির ও নাজিবও গুরুত্ব দিয়েছে।
মসজিদের শহর ঢাকা হলেও নান্দনিকতার দিক দিয়ে মালয়েশিয়ার মসজিদগুলোকে এগিয়ে রাখতেই হবে। নির্মাণে রয়েছে শিল্পের ছোঁয়া। এখানে যেমন ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে, তেমনি রয়েছে বৌদ্ধদের প্যাগোডাও। এখানকার ইতিহাসে ধর্মীয় সংঘাতের উদাহরণ নেই।
৬৯ সালের পর থেকে এ দেশে ঘটেনি কোনো জাতিগত দাঙ্গা। সমৃদ্ধ ও আধুনিক মালয়েশিয়া গড়তে ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ কনসেপ্ট জনগণের মধ্যে জাতিবোধের চেয়ে বড় করে তোলে দেশাত্মবোধকে।
বাংলাদেশ সময়: ০৫০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: শিমুল সুলতানা, অ্যাক্টিং কান্ট্রি এডিটর