কুয়ালালামপুর থেকে: কাউকে খাইয়ে সন্তুষ্ট করা বড় ইবাদত, ব্যবসাও ইবাদত। এটাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন কুয়ালালামপুরের কোতারায়া’র রাজধানী রেস্টুরেন্টের মালিক কাজী সালাউদ্দিন।
তাই মানুষকে খাওয়ানো-দাওয়ানোটা তিনি সন্তুষ্টি অনুযায়ী করতে চান। এভাবেই পূণ্য কামাতে চান নারায়ণগঞ্জের ইমাম সাহেবের ছেলে সালাহউদ্দিন।
তার হোটেলে বসেই কথা হয়। বাংলানিউজকে নিজের বিস্তর অভিজ্ঞতার গল্প শোনান তিনি।
বলেন, খাওয়া মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খাওয়া ভাল না হলে অস্থির লাগে, কোন কাজই ভালো লাগে না। তাই একথা মনে রেখেই কাস্টমারদের যত্ন করে খাওয়াই।
মালয়েশিয়ায় সফল বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একজন কাজী সালাউদ্দিন। তিনটি রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন কোতোরায়া ও আশপাশে।
শনিবার বিকেলে কথা হয় তার রেস্টুরেন্ট রাজধানী-১ এ বসে।
জানালেন, ১৯৯১ সালে কুয়ালালামপুর আসেন তিনি। তবে সোজা পথে নয়। ট্যুরিস্ট ভিসায় বিমানে আসেন থাইল্যান্ড। এরপর বাংলাদেশি দালালের হাতে বিক্রি হন থাই দালালের কাছে। তারপর জঙ্গলে কাটে ১২ ঘণ্টা। একটানা দৌড়াতে হয়। দৌড় কমিয়ে কেউ বসতে চাইলে তার ওপর পড়ে লাঠির বাড়ি।
সালাউদ্দিন বলেন, এ সময়টায় খানা-খন্দে পা পড়লেও, কেটে গেলেও তাকানোর সময় নেই। জঙ্গলে কিছুক্ষণ পরপর এজেন্টের লোকজন ছিল।
সকাল নাগাদ মালয়েশিয়ার গোলক বর্ডারে পৌঁছান তারা। এরপর বিক্রি করা হয় মালয় দালালের কাছে। ১০ মিনিটের মধ্যে মালয় দালাল ৪৮ চাকার এক লরি নিয়ে আসেন। গাড়িটা দেখানো হয়, চালের লরি হিসেবে। বিভিন্ন আঁকাবাঁকা পথে তাদের নিয়ে আসা হয় কেলাং মেরু। মোট ১০৮ জন লোক ছিল ওই টিমে। লরির সামনে ও পেছনে ছিল দু’টি ছোট প্রাইভেট কার। যারা রাস্তাকে আগে থেকে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে সিগন্যাল দিচ্ছিল।
কেলাং মেরুতে এসে দালাল তার বাসায় আলুর ভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ায়। দালাল তাকে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।
সালাউদ্দিন বলেন, সে সময় ৮ ঘণ্টার জন্যে ১৮ রিঙ্গিত বেশ ভাল কাজ ছিল। কিন্তু যেই রেস্টুরেন্টের সামনে শুকরের মাংস দেখি, আমি অন্য দরজা দিয়ে পালিয়ে যাই। যেহেতু দেশে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছিলাম, তাই ইংরেজি চর্চাও ছিল ভাল।
হারাম-হালালের ব্যবধানকে বেশ গুরুত্ব দেন সালাউদ্দিন। তাই কষ্টের হলেও কাজ করেন জুতার ফ্যাক্টরিতে। সেখানে সোল বানানো হতো।
’৯৪ সালে কুয়ালালামপুরে মাহাথির সোনু মার্কেট উদ্বোধন করেন। তখন সবচেয়ে জাকজমকপূর্ণ মার্কেট ছিল এটি। তিন বন্ধু মিলে দেখতে যান মার্কেট। সেখানে ছিল চিলি নামে এক রেস্তোরাঁ। সেখানে লেখা জব ভ্যাকেন্সি।
সালাউদ্দিন বলেন, আমি একবার সামনে আসি আরেকবার পেছনে। ভয় হয় এখানে কি আমার চাকরি হবে। ম্যানেজার দেখে আমাকে ডাকলো। বললাম, বিজ্ঞাপনটা দেখছিলাম।
উনি আমাকে ডেকে নিয়ে ক্যাপ আর অ্যাপ্রোন পরিয়ে দিলেন। সেখানে বেশ ভাল পারফরম্যান্স দেখালাম। আমি ৩ আঙ্গুলে ৩টা গ্লাস ধরতাম, তারা অবাক হতো। খুব জমজমাট হয়ে উঠেছিল চিলি রেস্তোরাঁ। সেখানে কাটে একটি বছর।
এখানে অন্য দশজন ব্যবসায়ীর মতো, আশপাশের বন্ধুরা সালাউদ্দিনকে বললেন, এখানে চাকুরি করে আর কয় টাকা আয় হবে। চলো দেশ থেকে মানুষ আনি।
বন্ধুদের প্ররোচনায় দেশে যান সালাউদ্দিন। কিন্তু মসজিদের ইমাম বাবা উদ্দেশ্যের মাঝে এসে পড়েন। বাবা আর পরিবারের সন্মানের দিকে তাকিয়ে ২২ দিনের মধ্যে আবারো মালয়েশিয়া চলে আসেন তিনি।
এরপর কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডসে কিছুদিন চাকরি করে কাজ জোটে আমেরিকান কোম্পানি ফেমাস এমোসে। কর্মতৎপর সালাউদ্দিন ৩ মাসেই পদোন্নতি লাভ করেন জুনিয়র সুপারভাইজার হিসেবে।
৬ মাসেই সুপারভাইজার হিসেবে হিসেবে পদোন্নতি হয়। এবার ৪টা দোকানের দায়িত্ব দেয়া হয় সালাউদ্দিনকে। বেশ ভালই আয় হয়, মাসে ৩ থেকে ৪ হাজার রিঙ্গিত। এ কোম্পানিতেই কেটে যায় ১১ বছর।
২০০০ সালে বিয়ের জন্য দেশে যান তিনি। কিন্তু দেশের মেয়েরা স্বাধীন না বলে তার মন টানলো না। ফিরলেন মালয়েশিয়া।
অবশেষে ২০০৫ সালে বিয়ে করেন মালয় চায়নিজ। স্ত্রী সু চাই ফং বয়সে অনেক ছোটো সালাউদ্দিনের। পরিবার, বয়স, ধর্ম- সব বাধা পেরিয়ে এখন সালাউদ্দিন আর সারা(বর্তমান নাম) সু চাই ফংয়ের সুখের সংসার।
খ্রিস্টান মেয়েকে মুসলমানে রূপান্তর করার শাস্তি হিসেবে সালাউদ্দিনের চাকরিতেও সমস্যা হয়। কোম্পানির নতুন খ্রিস্টান ম্যানেজার কাজের চাপ বাড়িয়ে দেন। শুধু শুধু হয়রানি করেন। ফেমাস এমোস ছেড়ে দেন সালাউদ্দিন।
২০১০ সালে কোতোরায়াতে নিজে রেস্টুরেন্ট দেন তিনি। একে একে এখন রাজধানী বিস্তার লাভ করছে। রাজধানী ১, রাজধানী-২, রাজধানী-৩ রয়েছে। সবগুলোতেই দেশি খাবার।
এছাড়াও শ্বশুর বাড়ি কেপং জিংজাওতে মিনিশপ দিয়েছেন তিনি। সেখানে শ্যালিকা বসেন। চায়নিজ শ্বশুর-বাড়ির লোকজন বিয়ে মেনেও নিয়েছেন। কোর্ট আর রাজার সহযোগিতায় মেয়েকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
দেশে আর পুরোপুরি ফেরার ইচ্ছে নেই সালাউদ্দিনের। তবে বউ নিয়ে বেড়াতে যান মাঝে মাঝে। বউ তার গ্রাম পছন্দ করেন।
দেশি ও গ্রামের খাবারের স্বাদ নিয়ে এসেছেন তার রেস্টুরেন্টে। কেউ বিদেশে বসে দেশের খাবার তৃপ্তি করে খাচ্ছে- এই দৃশ্য দেখতে তার ভালো লাগে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৪ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪