কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে: মানতেই হলো শাহরিয়ার ভাই রহস্য ঘেরা মানুষ। শেষ পর্যন্তও বলেননি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।
বারবার ফ্লাইট পেছানোতে আমাদের মধ্যে বিষণ্ণতার চেয়ে বিরক্তি ছিল বেশি। তবে আমপাংয়ের আয়ার্স টাওয়ারের নিচে পৌঁছালে দেখা মেলে ফুটফুটে শিশু টিপটিপে’র। বাবা জ্যাকির কোলে বসেই আমাদের অভিবাদন জানায় সে।
শাহরিয়ার ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু জ্যাকি, দুজনেই আহসানউল্লাহয় পড়তেন। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা। এবার দেখা মিললো, জ্যাকি ভাইয়ের সহধর্মিনী আয়েশা ভাবির সঙ্গে। রূপে আর কথায় অভিভূত হবে যে কেউ।
এই পরিবারের হাসিমাখা মুখগুলো আমাদের ফ্লাইট পেছানোর বিরক্তি ভোলাতে শুরু করলো। টাইমস স্কয়ার থেকেই আমাদের সঙ্গে রয়েছে ফেনীর ছেলে হীরণ, এখানকার এক কোম্পানিতে চাকরি করেন।
২ বছরের নূরে জান্নাত টিপটিপের মোবাইলের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। শাহরিয়ার ভাইয়ের মোবাইলের রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। কথায় বেরিয়ে আসে, টুকটুকের শখ রয়েছে আইফোন ভাঙায়।
জ্যাকি ভাইকে দেখে কিন্তু বেশ পরিশ্রমী মানুষই মনে হলো। তবে ভাবি বলে দিলেন, সে অলস। সকালে অফিসেও নিয়ে যেতে হয় আমাকে ড্রাইভ করে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যাকি ভাইয়ের মোবাইলে ফোন। বললেন, অমিত নিচে আসছে, নিয়ে আসি।
রুমে ঢোকেন অমিত দাস। সঙ্গে সুন্দরী স্ত্রী আর্শি। পুরনো একটা কথার সত্যতা টের পেলাম, প্রবাসীদের স্ত্রী যে সুন্দরী হয়।
সাতক্ষীরার ছেলে অমিত এখানে মাইক্রোসফটের একটি কনসার্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সাতক্ষীরার ছেলে যে আমুদে হবে সেটা বলার আর বাকি থাকে না। পুরো রুম একাই মাতিয়ে রাখতে পারেন তিনি।
আয়ার্স টাওয়ারের বারান্দা থেকে পুরো কুয়ালালামপুর শহরটাকেই দেখা যায়। টু্ইন টাওয়ারটাকে দেখে ইচ্ছে হয়, পকেটে পুরে ফেলি।
দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা হবে এটাই স্বাভাবিক। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২৫ লাখ বাংলাদেশি সামলাতে দূতাবাসের ৪২ জন কর্মকর্তা কি কি সমস্যার সম্মুখীন হন, সে কথা জানালেন জ্যাকি ভাই।
দূতাবাসে চাকরির সুবাদে এখানকার বাংলাদেশি দোকানে কিছু কিনলে অনেক সময় দাম রাখতে চায় না। জ্যাকি বলেন, তবে আমি জানি এ সুবিধা নিলে, পরের দিনই সে উৎকোচ দিতে চাইবে।
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই কুয়ালালামপুর রয়েছেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশিদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়াতে চান না, তাই কুয়ালালামপুর থেকে একটু দূরেই থাকেন।
প্রথম দিকে অফিসের প্রজেক্টগুলো শেষ করতে অনেক বেশি সময় লাগতো অমিতের। কোনো প্রবলেমের সলিউশন মাথায় আসলে মাঝরাতে ঘুম ভেঙেও বসতেন কম্পিউটারের সামনে। এখন ৬ মাসের প্রজেক্ট দেড় মাসেই শেষ করে বসে থাকেন।
টিপটিপ হেসে খেলে বেড়াতেই বেশি পছন্দ করছে। কারো কোলে চড়ে থাকার মেয়ে সে নয়।
হিরণ আট বছর ধরে এদেশে থাকে। অনেক খুটিনাটি বিষয়ও তার কাছ থেকে জানলাম। মালয় ভাষা ভালো বলতে পারেন, উচ্চারণও ভালো।
অমিত দা’র মতোই ও আর্শি বৌদি ভীষণ আমুদে। স্বামী-স্ত্রী যেন প্রিয় বন্ধু। ‘জীবনটা উপভোগের বিষয়’- এই নীতিতে বিশ্বাসী তারা।
জ্যাকি ও আয়েশা দম্পতির সাবলীল আন্তরিকতায় আমরা ক্রমশ মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এখানকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বললেন অনেক কিছু।
সারাদিনের ব্যস্ততায় স্ত্রীর কাজে সাহায্য করার সুযোগ পান না জ্যাকি। স্নেহভরা কণ্ঠে সেসব নালিশই করছিলেন আয়েশা। তবে কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল- এসব নালিশ নয়, স্বামীর প্রতি গভীর মমতা, আর নিজের সংসার আগলে রাখার তৃপ্তি।
চেহারার কারণে তামিল মনে করে তামিলরা তাকে বাড়তি খাতির করে বলে জানালেন আয়েশা। তবে বাংলা আর ইংরেজি না জানা মানু্ষের সঙ্গে কথা বলতে সমস্যা হয় তার। এখনো মালয় বা তামিল কোনো ভাষাই আয়ত্ব করতে পারছেন না বলে আক্ষেপ করলেন।
এক পর্যায়ে খেতে ডাকলেন। বাঙালি খাবারের ঘ্রাণেই যেন অর্ধভোজন হল। চোখের দেখায় তৃপ্তি বাড়লো।
প্রথমেই লাচ্ছি দিয়ে আপ্যায়ণ করা হয়েছিল। এবার পোলাও, খাসি, ইলিশ ভাজি, মুরগির ঝাল কারি, মাছ-ডালের একটি রেসিপি, সালাদ, ড্রিংকসসহ আরও নানা আয়োজন।
মালয়েশিয়ায় বেশিরভাগ খাবারেই মিষ্টি স্বাদ। কত আর ভালো লাগে! আয়েশা রহমানের রান্না তাই অমৃত মনে হল আমাদের জিভে। দেশি স্বাদ, দেশি ঘ্রাণ, দেশি আবহ-ভালো না লেগে উপায় নেই।
খাবার শেষে ডেজার্ট হিসেবে রয়েছে কাস্টার্ড ও পুডিং।
আয়েশা বললেন, এখানে আমার পরিচিতদের মধ্যে কাস্টার্ড ‘জাতীয় খাবার’ এ পরিণত হয়েছে। সবাই কাস্টার্ড তৈরি করে। এটা আমার খুব পছন্দের খাবার বলে যেখানেই যাই, একটু চেখে দেখতে বলে।
মুখে দিয়েই বুঝলাম, আয়েশার কাস্টার্ডের স্বাদ দীর্ঘদিন ভুলবো না।
মালয়েশিয়ার বুকে বাংলাদেশের স্বাদ আর ঝাঁজ নিয়ে পরিপাটি একটি সংসার টিপটিপদের। অপ্রত্যাশিতরকম ভালো কাটলো কিছু সময়। বিদেশের বুকে দেশের মানুষদের এই ভালোবাসা মনে থাকবে আজীবন।
শাহরিয়ার ভাই ইউনিভার্সিটি কেবাংসাং মালয়েশিয়ায় পিএইচডি করছেন। থিসিস তৈরিতে বেশ ব্যস্ত। তাই সবাইকে তাড়া দিলেন আড্ডা ভাঙার। তবে অমিত’দা আড্ডায় নেশাগ্রস্থ। শেষ পর্যন্ত বললেন, আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেবেন তিনি। একই সঙ্গে বলে দিলেন, পরেরবার আসলে যেন, আর হোটেলে না উঠে, সোজা উনার বাসায় চলে যাই।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫২ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৪