মালয়েশিয়া: ১৭ অক্টোবার সকাল ছয়টা। সারারাত বৃষ্টি।
তড়িঘড়ি করে বিশাল আলখাল্লা পরে ট্যাক্সিতে উঠতেই চালকের বিশাল অভিনন্দন। পরে অবশ্য আমি যখন বাংলাদেশি পরিচয় দিলাম, অভিনন্দন থেকে অবাক হবার পরিমাণটা বেশি দেখতে পেলাম।
যাই হোক, দীর্ঘ জ্যামের ধাক্কা পেরিয়া পৌঁছালাম সেই স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি মালায়াতে। আজকের দিনটা অন্যরকম সাজে সেজেছে পুরো ক্যাম্পাস। অভিনন্দনের পর অভিনন্দন।
ভেতরে প্রবেশের সারিতে দাঁড়াতেই এক সিনিয়র আপু এসে টাই বেঁধে দিলেন এবং মাথার চৌকোণ ক্যাপটি ঠিক করে দিলেন। মুচকি হেসে বললেন, আজকে একটু ওভারস্মার্ট ভাবে সাজতে হবে তোমাদের, অনেক ছবি তুলতে হবে।
সারিবদ্ধ ভাবে হলের ভেতর প্রবেশ করলাম। চারদিকে মানুষ। প্রায় ৫ হাজার মানুষের উপস্থিতি। চ্যান্সেলর এবং ভাইস চ্যান্সেলর’র প্রতীক্ষায়। এদিকে সেলফি তোলায় ব্যস্ত সবাই।
পুরো অনুষ্ঠান পরিচালনায় রাখা হয়েছে কমপক্ষে পাঁচশ’ জন। প্রতিটি ধাপেই একজন করে রয়েছেন যিনি আপনাকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। আমাদের সবার হাতে হাতে স্মার্ট কার্ড ধরিয়ে দাওয়া হলো। স্ক্রল নেওয়ার পূর্বে সেই কার্ড ছোয়া লাগালেই বেজে উঠবে আপনার নাম এবং পর্দায় আপনার ছবি। শৃঙ্খলতার দৃষ্টান্ত দেখে বেশ অবাক হলাম।
বিভিন্নজন আবার বিভিন্ন ভঙ্গিতে স্ক্রল গ্রহণ করল। মাঝে মাঝে দর্শকের সারি থেকে অনেকে গেয়ে উঠল জনপ্রিয় গান। আয়জন ছিল ব্যান্ড দলের, বিভিন্ন সঙ্গীত পরিবেশনার।
অনুষ্ঠান শেষ হল এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে। কিন্তু আসল মজা, হল থেকে বের হবার পর। অভিনন্দনের ফুলের তোড়া আর পুতুল। সবাই সবার জন্য অপেক্ষা করছে। আকাশে রয়েছে ড্রোন ক্যামেরা। অনভুতিটাই অন্যরকম। কেউ এসেছে বিশাল সাইনবোর্ড নিয়ে, আবার কেউ কেউ একসাথে মিলে করছে ফ্ল্যাশমব বা দলীয় নৃত্য। দিনটিকে মনে হচ্ছিল কোনো গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের দিনের মতো।
এবার কিছু কথা না বলার নয়। একসময় এমন ছিল যে মালয়েশিয়ানরা পড়াশুনার জন্যও দূর দেশ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আসত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মালয়েশিয়ান পড়াশুনা করেছেন। আর এখন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী আসছেন মালয়েশিয়ায়। মেধাগত দিক থেকে আমি বলব এখনো আমরা অনেক এগিয়ে, কিন্তু, বিষয় , প্রযুক্তি এবং আচার-ব্যবহারগত দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে।
প্রথম যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম, সিনিয়র এবং শিক্ষকদের সাহায্য এবং উদারতা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। সবাই এটাই বার বার বলছিলেন এখানে একটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হওয়া মানে শুধুমাত্র মেধার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ হওয়া নয় বরং আচার আচরণগত দিক থেকেও সবার উপরে থাকা।
আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু বাংলাদেশের কিছু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভ টিজিং এর শিকার হয়ে নিরুপায় হয়ে পড়াশুনা বন্ধ করে বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। আর র্যাগিং এর জন্য অনেকের বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছে এরকম উদাহারণ হাজার হাজার। একটি দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মন মানসিকতাই যদি এমন হয় তাহলে প্রশ্ন করবেন কাকে?
এবার আসি ছাত্র রাজনীতির কথায়। ছাত্র রাজনীতি এখানেও রয়েছে। তবে তা শুধু কানে শুনেছি, চোখে দেখার সুযোগ হয়নি। কারণ আপনি যদি মিটিং মিছিল করতে চান তাহলে তা করতে হবে ছুটির দিন যাতে সাধারণ মানুষের ব্যাঘাত না ঘটে। এবং অনুমতি নিতে হবে কমপক্ষে ২ সপ্তাহ আগে। অবাক লাগলেও এটাই সত্যি।
আমাদের দেশে মেধা পাচার একটি অভিশাপ। একটি শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর বাংলাদেশের কথা আরও ভিন্ন । হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় পরাজিত করেই পেতে হয় সেই কাঙ্ক্ষিত সিট। এরপর যদি চলে এসব কুরুচিপূর্ণ ব্যবহার তাহলে যাদের কিছুটা সামর্থ রয়েছে, তারা দেশ ছেড়ে কেন যাবে না বলুন?
‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’ প্রমথ চৌধুরী’র উক্তিটির তাৎপর্য এখন বুঝতে পারছি। স্বশিক্ষিত হবার দিক থেকে আমরা যে কতটা পিছিয়ে তা উল্লেখ করার মতো।
নিয়মানুবর্তিতা, নীতিবিদ্যা, শিষ্টাচার এবং অধ্যবসায় জ্ঞান যে সমান গুরুত্বপূর্ণ তা সবার জানা উচিত।
তবে আক্ষেপ থেকে আনন্দটাই অনেক বেশি। যখন স্ক্রল নিতে মঞ্চে উঠেছিলাম নামের পরে মাইকে বলা হলো ‘বাংলাদেশ’। গর্বে বুক ফুলে গেল। আর এ সময় যখন আমার বাবা সামনে দাঁড়িয়ে তখন সেই মুহূর্তের অভিজ্ঞতা মনে হল অলিম্পিকে সোনা জেতার থেকেও অনেক বড়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪