কুয়ালালামপুর (মালয়েশিয়া): ঘটনা-১: রবিন মালয়েশিয়ার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিন বছর হলো মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন সুন্দর একটি ভবিষ্যত গড়ার আশায়।
এই নভেম্বর মাসেই হংকংয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করতে হবে তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারভাইজারের পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তিনদিনের এই সম্মেলনে যোগ দেবে দেশে-বিদেশের মোট ১০০ জন শিক্ষার্থী।
রবিনের নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই যাচ্ছে চারজন। ফ্লাইটের টিকিটও কেনা শেষ। সবার পাসপোর্টও জমা দেওয়া হয়েছে ভিসার জন্য। সবার ভিসা আসলেও রবিনেরটা এলো না।
রবিন দূতাবাসে যোগাযোগ করলেও এর কোনো উত্তর নেই। কর্মকর্তার একটাই উত্তর- ভিসা না হওয়ার কারণ প্রকাশ না করার অধিকার তাদের আছে। ভিসা ফিসও ফেরত দেওয়া হবে না।
রবিনের বিভিন্ন দেশের বন্ধুরা ব্যস্ত তাদের মালামাল গোছানোর কাজে। রবিনের আক্ষেপ, শুধু তার সবুজ পাসপোর্টের প্রতি!
ঘটনা ২:
শুক্রবার রাত একটা ৪৫ মিনিট। আবির এবং তার তিন বন্ধু সিনেমা-থিয়েটার থেকে বাড়ি ফিরছে। পথিমধ্যে, পুলিশি পাহারা। আবিরের সঙ্গে জাপানি, ফরাসি এবং মালয় বন্ধুও রয়েছে।
সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হলো। পালা এলো, আবিরের। তার বেলাতেই শত প্রশ্ন! অন্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র দেখামাত্রই ছেড়ে দিলেও আবিরের বেলায় পাসপোর্ট দেখতে চায় পুলিশ।
আর সবুজ পাসপোর্ট দেখামাত্রই মনের মধ্যে যেন এক ধরনের বিরক্তির ছাপ তাদের! অদ্ভুত সব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, সে। সারারাতের আনন্দ যেন শেষ হয়ে যায় এক নিমিষেই!
ঘটনা ৩:
বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মাজেদুল নয়ন যখন মালয়েশিয়ায়, তখন তার সিঙ্গাপুরের ভিসার আবেদন করতে দূতাবাসে গেলাম। সব দেশের নাগরিকেরা অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন, শুধুমাত্র বাংলাদেশিদের উপস্থিত থেকে আবেদন করতে হবে!
ভালো কথা! প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জোগাড় করে যাওয়া হলো দূতাবাসে। অফিসের কর্মকর্তা পাসপোর্ট সাইজ ছবি দেখে বললেন- ছবি পুরনো। নতুন ছবি আনতে হবে।
শত যুক্তি দেখালেও তিনি মানতে রাজি নন। অন্যান্য আবেদনকারীর সঙ্গে দিব্যি হাসিমুখে কথা বলছেন তিনি। আর বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখেই তার মুখ গোমড়া!
এ রকম আরো শত শত অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বৈধভাবে যারা অন্যান্য দেশ পাড়ি দিতে চান, তাদেরও পোহাতে হয় নানান ঝামেলা। অতিরিক্ত ফিস ছাড়াও কর্মকর্তাদের খারাপ ব্যবহার তো আছেই।
অগ্রিম টিকিট কেটে খোয়াতে হয়, বড় অংকের টাকা। এ জন্য অভিযোগও করা যাবে না। কারণ, ভিসা আবেদন বাতিল করার অধিকার তাদের আছে। বলতে গেলে, আপনি পুরোপুরি নিরুপায়।
শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিক:
এখন আসি, মজার পরিসংখ্যানে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশের স্থাপনা এবং বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে সবার পছন্দ বাংলাদেশি শ্রমিক। প্রশ্ন হলো- কেন? কারণ, একমাত্র বাংলাদেশি শ্রমিকেরাই ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা হাসিমুখে কাজ করতে পারেন।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিজস্ব চাহিদা কম এবং অল্পতেই খুশি তারা। তাই, মালিকদেরও বাংলাদেশি শ্রমিক পছন্দ বেশি।
প্রতিটি স্থাপনার কাজে টেন্ডারে প্রথমেই রাখা হয়, বাংলাদেশি শ্রমিকদের তালিকা। তাদের অর্থনৈতিক লাভের একটি বড় কারণ, কমমূল্যের বাংলাদেশি শ্রমবাজার।
শিক্ষায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর চাহিদা:
শ্রমবাজার থেকে আসি শিক্ষাক্ষেত্রে। মালয়েশিয়ায় স্নাতকোত্তর পড়াশুনায় অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের লেখা জার্নাল, লেকচার নোট এবং রিপোর্ট বেশি ব্যবহৃত হয়। কারণ, অতিনিঁখুত এবং সহজভাবে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের লেখা জার্নাল বা লেকচার নোট সাজানো থাকে। এগুলো শুধুমাত্র এখানকার শিক্ষার্থীরাই নয়, শিক্ষকদের কাছেও অনেক কদর আছে।
মিথ্যা দোষারোপ:
তবে হ্যাঁ, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশিরাও অনৈতিক ও অবৈধ কাজে জড়িত থাকেন। তবে তার সংখ্যা অতি নগণ্য। কিন্তু, সেটাকেই বড় করে দেখানো হয়।
এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতি সবার অনুরোধ, দূতাবাস থেকে যেন বৈধ বাংলাদেশিদের পরিচয়পত্র অথবা চিহ্নিতকরণের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়। এই ব্যবস্থা যেন মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতিতেই তৈরি করতে হবে দেবে।
মালয়েশিয়ায় প্রায় সাত লাখ বাংলাদেশি বাস করেন। তাই, বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশিদের সামর্থ্য ও যোগ্যতা তুলে ধরার কর্মসূচি নিতে হবে।
মালয়েশিয়ায় বসবাসকারীরা সবাই আশাবাদী মানুষ। তারা মনে করেন, সব দূর্বলতাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের নামও একদিন উচ্চারিত হবে সব উন্নত দেশগুলোর কাতারে। থাকবে না আর কোনো অভিযোগ। থাকবে না, আর কোনো হতাশার গল্প! সেই দিনের অপেক্ষায় আমরা!
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৪