ঢাকা: আগামী ১৪ নভেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘শোকেজ বাংলাদেশ-২০১৪’ নামে প্রদর্শনী। এ মেলায় আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের (বিএমসিসিআই) সাবেক সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম।
ওয়েল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম গত শনিবার বিকেলে নিজ কার্যালয়ে এ প্রদর্শনীর বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন বাংলানিউজের সঙ্গে।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। অনেক সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মালয়েশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সর্ম্পক সেভাবে গড়ে উঠেনি। বাংলাদেশ নিজের দিক থেকে লাভবান হতে পারছে না। অথচ মালয়েশিয়ায় শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা নিলে সফল বাণিজ্য সম্ভব বলে মনে করেন নুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় আমরা গত ২ বছর ধরে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশাধিকার সুবিধা পাচ্ছি। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আমরা এ সুবিধার পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহার করতে পারছি না। তাই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এ সুবিধার পূর্ণাঙ্গ সদ্ব্যবহার করা উচিত।
তবে কিছুটা উন্নতির আভাস দিয়ে তিনি জানান, আগে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল ৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো। এখন এটা একশ‘ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় পণ্য হিসেবে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, পাটজাত পণ্য, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আলু রফতানি হচ্ছে।
দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বন্ধুত্বের ভিত অনেক শক্ত। ওই দেশের সরকার আমাদের সাথে ব্যবসা বাড়াতে চায়। কিন্তু তাদের চাওয়ার সাথে সাথে আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদেরও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে।
তিনি বলেন, ইউরোপ বা আমেরিকায় তৈরি পোশাক বিক্রি করতে আমাদের ব্যবসায়ীদের অনেক বেগ পেতে হয়। কিন্তু পার্শ্ববতী দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রফতানি করতে আমরা কোনো চেষ্টা করি না। মালয়েশিয়ায় আমরা তৈরি পোশাক রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকি। আমাদের সে সুযোগটা নিতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশের শতাধিক পণ্য সে দেশে শুল্ক মুক্ত সুবিধায় প্রবেশ করতে পারে।
নুরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ার অর্ডারগুলো অনেক ছোট। এ জন্য হয়তো আমাদের ব্যবসায়ীরা সেখানে আগ্রহী নয়। কিন্তু ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা সেখানে সহজেই তৈরি পোশাকের বাজার ধরতে পারেন। মূল কথা হলো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও আমাদের দেশের গার্মেন্টস উদ্যোক্তারা মালয়েশিয়াকে গুরুত্ব দেন না। ফলে দুই দেশের আমদানি-রফতানিতে ব্যবধান রয়ে গেছে।
তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শোকেজ বাংলাদেশ। মেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, সবাই ধারণা করে মেলায় আমরা হাজার হাজার ডলারের অর্ডার পাব। কিন্তু আসলে সেটা না। আন্তর্জাতিক মেলা হচ্ছে দেশের ইমেজ বাড়ানোর জায়গা। তাই আমাদের এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
নুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বারের উদ্যোগে দুই ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। যার একটা হলো ‘শোকেজ বাংলাদেশ’। যেটা আমরা মালয়েশিয়াতে গিয়ে অংশ নেই। অন্যটি হলো ‘শোকেজ মালয়েশিয়া’। যেটা তারা আমাদের দেশে এসে অংশ নেয়। মালয়েশিয়ায় এটা তৃতীয় মেলা।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়া খুবই সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ অঞ্চল। মালয়েশিয়া যতটা না আমাদের পণ্যের বাজার, তার চেয়ে বড় কথা তাদের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে মালয়েশিয়া বিনিয়োগ করতে পারে। কারণ তাদের টেকনোলজিক্যাল সার্পোট আছে।
গত ২০ বছরে মালয়েশিয়া অনেক এগিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা, ব্রিজ, রাস্তাঘাট নির্মাণে তারা অনেক এক্সপার্ট। সব কিছু মিলিয়ে তৃতীয় শোকেজ বাংলাদেশ মেলায় ব্রান্ডিং বাংলাদেশ করার চেষ্টা করবো। মেলায় মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াবে। বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে।
নুরুল ইসলাম বলেন, স্পিনিং মিল, টেস্কটাইল মিল, বিস্কুট ফ্যাক্টরি করা আমাদের পক্ষে কঠিন কোনো কাজ না। বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হওয়ায় তা সম্পন্ন করা আমাদের জন্য একটু কঠিন। এসব ক্ষেত্রে আমাদের টাকা থাকলেও দেখা যায় টেকনোলজি সার্পোট থাকে না। যেমন আমাদের বিদ্যুৎ প্রয়োজন। মালয়েশিয়া এখন বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করছে। তারা আমাদের পদ্মা সেতুতেও বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলো।
তিনি বলেন, আমাদের জাতীয় দায়িত্ব মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা। কারণ তাদের ধারণা বাংলাদেশে শ্রমের মূল্য কম। কিন্তু আমরা বলতে চাই ‘উই আর গুড কান্ট্রি ফর হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড গুড ফর লার্জ ইনভেস্টমেন্ট। ’
গত বছরের মেলা সর্ম্পকে তিনি বলেন, সেবার আমরা রেমিটেন্সকে গুরুত্ব দিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের ৫ লাখ বৈধ শ্রমিক থাকে। তারা বৈধ পন্থায় বাংলাদেশে এক বিলিয়ন ডলার পাঠায়। তাছাড়া মালয়েশিয়ার স্থানীয় কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশের ব্যাংক অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সংস্থাগুলো সর্ম্পকে জানতে আগ্রহী।
মেলায় ‘ইনভেস্ট অপরচুনিটি অব বাংলাদেশ’ এবং ‘ইপিজেড অ্যান্ড ইনফ্রাসট্রাকচার’ নামের দুটো সেমিনার থাকবে। সেখানে দেশকে ব্র্যান্ডিং করতে ভাল কিছু কোম্পানিকে নিয়ে যাচ্ছি। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা ব্যাংক, গ্রীন ডেল্টা, সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, রুপালী ব্যাংক, আব্দুল মোমেন, ওয়েল ফুড, বিবিএস। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে ৩০টি কোম্পানি মেলায় অংশ নেবে।
নুরুল ইসলাম বলেন, ব্র্যান্ডিং বলতে, তাদেরকে বাংলাদেশ সর্ম্পকে ভাল ধারণা দেয়া। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশ। এখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। আমাদের রাস্তায়, বিদ্যুতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। পিপিপির মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে কাজ করা যেতে পারে।
মেলার সফলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি মেলা নিয়ে বেশ আশাবাদী। গতবারের দুর্বল দিকগুলো কাটিয়ে এবার আরো ভাল করে শুরু করবো। আসলে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে ব্রান্ডিং করতে একদিন বা একটি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। যেমন প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার বেশি সাড়া ছিল এবার আশা করি আরো বেশি সাড়া হবে।
তিনি বলেন, আমার মতে অন্তত একজন ইনভেস্টরও যদি এ মেলার মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে সেটি চেম্বারের বড় সাফল্য। যদি একটি বড় কোম্পানি আমাদের একটা রাস্তা, বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে বিনিয়োগ করে আমি ভাববো এটাই আমাদের সাফল্য। এছাড়া সরকারি হাইটেক পার্কগুলোতে পিপিপি’র মাধ্যমে মালয়েশিয়ানরা বিনিয়োগ করতে পারে।
মেলায় বাংলাদেশ থেকে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া মালয়েশিয়ার শিল্পমন্ত্রী, জ্বালানিমন্ত্রীও উপস্থিত থাকবেন।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির কথা আবারো উল্লেখ করেন তিনি।
নুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে তারা বিলিয়ন অংকের রফতানি করলেও আমরা মাত্র ১০০ মিলিয়নের কিছু বেশি রফতানি করি। আমাদের চেয়ে তাদের সক্ষমতার জায়গাটা অনেক বেশি। মালয়েশিয়া পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশ। আমরা পেট্রোনাসের কাছ থেকে তেল ক্রয় করি। সেদিক দিয়ে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি সবসময় থাকবে। তবে আমরা যদি তৈরি পোশাক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আরো মনোনিবেশ করি এবং মালয়েশিয়াতে রফতানি বাড়াতে পারি তবে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমবে। হুট করে এ ঘাটতি কমে আসবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০১৪