কুয়ালালামপুর থেকে: মালয়েশিয়ায় এবার বৃষ্টিটা একটু বেশিই। থেমে থেমে বৃষ্টি।
শহরের যান্ত্রিকতা ছেড়েছি অনেকক্ষণ। একটা বিমান ল্যান্ড করছে। বুঝলাম এটা এয়ারপোর্টের পেছন দিক। বেশ কিছু স্ট্রিট রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আকাঁবাকাঁ রাস্তায় যেতে যেতে অমিত দা বললেন, এখানে আমি আর তোর বৌদি এসে মাঝে মাঝে বসি। বেশ ভাল লাগে। একটু মজা করেই বললাম, ও এটা সাগরপাড়! হো..হো.. করে হেসে উঠলাম- আমি, দাদা, আর ফোনের ও প্রান্তে থাকা বৌদি।
দাদা বললেন, বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানির ফ্যাক্টরি এখানে। কমপক্ষে ৪০ হাজারের মতো বৈধ শ্রমিক এখানকার ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজ করছেন।
প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর একটি বাড়ি। ফটকের মতো বড় গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই সামনে খোলা জায়গা। অভ্যর্থনা জানালেন সাতক্ষীরার অনুপ দাশ আর খুলনার রুঞ্জন রায়। সামনে বারান্দার মতো স্থানে দুটো টুল নিয়ে জমলো আমাদের আড্ডা। অমিত দা'র গল্প শুরু হলে শেষ হতে চায় না। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন বয়সে একটু প্রবীণ রংপুরের হারুনুর রশীদ।
২০০৭ সালের কলিংয়ে বৈধ উপায়ে এখানে এসেছেন এসব শ্রমিক। তারা এখন মালয়েশিয়ার অন্যতম বড় গাড়ির বডি তৈরির কারখানা এমপিএসআই'তে কাজ করছেন। কোম্পানির বেশ সুনাম করলেন তিনজনই।
ভাল কোম্পানিতে বৈধ শ্রমিক হিসেবে সুযোগ সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে তারা জানালেন, এখানে মালিক ও শ্রমিকে সর্ম্পক কাজের। মালিকপক্ষ অযথা শ্রমিকদের হয়রানি করে না।
এখানে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, ভিসা নিয়ে ভাবতে হয় না শ্রমিকদের। কোম্পানি নিজ খরচে ও তত্ত্বাবধানে ভিসা করে দেয়। এছাড়াও চিকিৎসা ব্যয় বহন করে কোম্পানি। এমনকি অসুস্থ থাকা অবস্থায় ছুটিতে থাকলেও সেদিনের বেতন দেয়া হয়। এ কোম্পানিতে শ্রমিকের রয়েছে নির্দিষ্ট বেতন স্কেল ও অন্যান্য ভাতা। আর ওভারটাইম অনুযায়ী উপরি বেতনতো রয়েছেই।
সবাই জানালেন, বছর শেষে ২ মাসের বোনাস দেয়া হয় তাদের। যেটা পুরো দু’মাসের বেতনের সমান। এছাড়াও রয়েছে কোম্পানি ইন্স্যুরেন্স। আর সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াও বছরে সরকারি ছুটির প্রতিটিতো রয়েছেই।
এছাড়াও ৬ মাস পর পর দুটি করে কোম্পানির গেঞ্জি এবং বছরে একবার জুতো দেয়া হয়। আর বিশেষ যে সুবিধা, সেটি হচ্ছে নিরাপদ এবং সুন্দর একটি বাসস্থান। যেটার খরচ কোম্পানিই বহন করে। আর মাসের শুরুতেই নিজের ব্যাংক হিসেবে জমা হয় ফেলে আসা মাসের বেতন।
অনুপ দাশ জানালেন, এখানে শুধু রান্নার খরচটাই নিজেদের। আর বাকি খরচ কোম্পানিরই। নিজেরাই রান্না করেন এখানে। কেউ নিজস্ব ব্যাবস্থাপনায়, আবার কেউ জোট গড়ে।
মালয়েশিয়ায় নিজেদের ভাগ্য কতটুকু পরিবর্তন করেছেন, জানতে চাইলাম। বেশ হিসেব কষে হারুনুর রশীদ জানালেন, ২০০৭ সালের দিকে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকার জমি বিক্রয় করে এ দেশে এসেছেন তিনি। এখন দেশে বেশ কিছু জমি হয়েছে আবার। একটু হেসে নিজেই বললেন, আর একটি ফ্ল্যাট বাড়ি (পাকা দালান) হয়েছে। অথচ ২০০৭ এর আগে বাড়িতে মৌসুমী কৃষি কাজ করে চলছিল সংসার।
এক সময় সাতক্ষীরার দেবহাটার কুলিয়া গ্রামের অনুপ কিছুটা বখাটেই হয়ে পড়েছিলেন। বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান এক সময় পাড়ি জমান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। ভিনদেশে আসার ৪র্থ মাসেই স্বর্গবাসে চলে যান পিতা।
কিছুটা নীরবতা। এরপর নিজেই বললেন, এখন বেশ ভাল আছি। পরিবারকে আর্থিকভাবে এবং স্বিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য করতে পারছি। দেশে থাকলে যে অনুপের মধ্যে এ পরিবর্তন সম্ভব ছিল না, এটা তারই জবানবন্দি।
আর খুলনার পুটিমারির রঞ্জন উচ্চ মাধ্যমিকের পর বেকার হয়ে ঘুরছিলেন। দেশে যখন নিজের পরিশ্রমের যোগ্য মূল্যায়ন বা সুযোগ পাচ্ছিলেন না, তখনই নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় এসে বদলেছেন নিজের ভাগ্য। এখন নিয়মিত দেশে পরিবারে অর্থ যোগান দিচ্ছেন।
কিছুটা দেরিতেই বিয়ে করেছেন অনুপ। বয়সের কথা নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন। মাথায় চুলের অভাব দেখে আমি অনুমানে ৪০ বলাতে কাছাকাছি হলো। তার বয়স এখন ৪১। বিয়ে করেছেন গত বছরে। অমিতদা'ই জানালেন, বেশ কম বয়সী বধুই ঘরে তুলেছেন অনুপ।
আর্থিক সফলতা রয়েছে এখন রঞ্জনের। মাস দুই হলো ঘরে বৌ তুলেছেন। এই দুজনই ২০০৭ এর পর বাড়ি গিয়েছেন একবার করে। তবে বিয়ের পর যে বেশি বেশি করে বাড়ি যেতে হবে, সেটা স্মরণ করিয়ে দিলেন অভিজ্ঞ হারুনুর রশীদ।
রংপুরের পীরগাছার গ্রামে নিজের গড়ে তোলা ফ্ল্যাটে স্ত্রী পারুল, ছেলে আর ছেলের বৌ নিয়েই হারুনের সংসার।
বাসার একদম কাছেই ফ্যাক্টরি, হাঁটা দূরত্বে। এই বাসায় মোট আট জন বাংলাদেশি শ্রমিকসহ বিভিন্ন দেশের ১৪ জনের বাস। দেশিদের তিনজন এখন দেশে রয়েছেন। আর মুন্সীগঞ্জের নূর মোহাম্মদ ও যশোরের মামুন রয়েছেন বাইরে।
ঘুরে দেখলাম বাসার ভেতরটা বেশ খোলামেলা। রুমে ফ্রিজ, টিভি সবই রয়েছে। রয়েছে বেশ খোলামেলা ডাইনিং আর রান্নার সুব্যবস্থা।
জানালেন, এই কোম্পানির তিনটে ফ্যাক্টরি রয়েছে এখানে। এ দুই ফ্যাক্টরিতে ১৮ থেকে ২০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের নিজেদের ফ্যাক্টরিতে সবমিলিয়ে বিভিন্ন দেশের ৭৪ জন শ্রমিক রয়েছেন।
শ্রমিকরা জানালেন, এ অঞ্চলে বৈধ শ্রমিকের বাসই বেশি। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা দশ পেরিয়ে গেলো। এবার যাবার পালা। কিন্তু অমিত দা'র সঙ্গে হৈ-হুল্লোড়ের লোভে কাপড় পরিবর্তন করে চলে এলেন অনুপ দা। পরের দিন সকালে ফ্যাক্টরিতে নিজের দ্বায়িত্বের কথা ভুলে বসেছিলেন। আবারো স্মরণ করিয়ে দিলেন দুই সহকর্মী।
শেষ পর্যন্ত আর বের হলেন না অনুপ। কোম্পানি থেকে ৭৪ জন শ্রমিকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আটজনকে। তার মধ্যে তিনিও যে একজন।
সুবাং থেকে ক্লাং লামার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। ঝুম বৃষ্টিতে চলতে শুরু করলো হোন্ডা সিটি। হাতের বামপাশে একটা নার্সারি দেখিয়ে দাদা বললেন, তোর বৌদি এখান থেকে ফুল চুরি করে।
** মালয়েশিয়ায় বাঙালি পরিবার, আমাদের আড্ডা
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৪