কুয়ালালামপুর: মালয়েশিয়ার ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছাড়া পেয়েছেন দিন ছয়েক আগে শাজাহান। আঙ্গুল দিয়ে শার্ট এর কলার টেনে ঘাড়ের পাশের দাগগুলো দেখাচ্ছিলেন তিনি।
টেনে নিয়ে ছোট্ট এক রেস্টুরেন্টে বসলাম। জানতে চাইলাম বিস্তারিত। গলা শুকিয়ে আসছিল তার। বললাম কি খাবেন খান। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আপনার শরীরে শক্তি দরকার।
শাজাহান এর বাড়ি ভোলা জেলায়। তবে গ্রামের বাড়ির ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনি। বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো তাকে। গত ২০ নভেম্বর মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি নৌকায়। মাত্র ৪০ হাজার টাকায় চলে আসেন এদেশে।
২০১৩ এর ফেব্রুয়ারি। শাজাহানের এলাকার মালয়েশিয়া ফেরত আনিসুর তাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যেতে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। তবে কিছুতেই শাজাহান নৌকায় করে জেতে রাজি হননি। তাকে বলা হয়, প্রথমবার সবাইকেই এরকম নৌকায় করেই যেতে হয়।
শাজাহানের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা খারাপ নয়। ভিটে-বাড়ি-সম্পদ বলতে মোটামুটি ভালই রয়েছে। তবে মাত্র ৪০ হাজারে মালয়েশিয়া যাত্রার লোভ সামলাতে পারেননি তিনি। স্ত্রীর কথা অগ্রাহ্য করে প্রস্তৃতি নেন মালয়েশিয়া যাত্রার। এর পরের কাহিনী আরো দশটি বিভীষিকাময় কাহিনীর মতোই।
নৌকায় রাতের পর রাতের বিনিদ্র যাত্রার কথা অবর্ণনীয়। কাঁচা মাছ আর লবণাক্ত পানি খেয়ে দিন কাটে শাজাহান ও অন্যান্য বাংলাদেশির।
তিনি জানান, তাদের দলে মায়ানমারের রোহিঙ্গারাও ছিলেন।
তাদের দল পৌছায় পূর্ব মালয়েশিয়ার সাবাহ অঞ্চলে। এরপর একদিনের বিরতিতে ট্রাকে করে তাদের কোটাকিনাবালু স্থানে নিয়ে যাবার পথে টহল দেওয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি।
সে সময় বিশেষ অভিযান চলছিল পুরো মালয়েশিয়া জুড়ে। গ্রেপ্তারের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিটেনশন সেন্টারে। তিনি মনে করেছিলেন, অল্প কিছুদিনেই হয়ত ছাড়া পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়নি তার।
কথা বলতে বলতে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলেন না সাজাহান।
মালয়েশিয়ার ডিটেনশন সেন্টারের মর্মান্তিক বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি। ছোট, মধ্যবয়সী আর বয়স্ক সবাইকে একই চোখে দেখা হয় সেখানে। সেন্টার এর ভেতর দোকান থেকে উচ্চমূল্যে টাকা দিয়ে কিনতে হয় খাবার। সেই প্রিজন সেলে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ জনের জন্য রয়েছে একটি শৌচাগার।
মাঝে মাঝে মাঝরাতে এ সব ডিটেনশন সেন্টারে চলত প্রহার। প্রতিদিন তাদের সেন্টারের মাঝে এনে বসানো হতো এবং করা হতো নানা প্রশ্ন। ভাষাগত দিক থেকে পারদর্শী না থাকায় কিছুই বুঝতে পারতেন না তিনি।
তিনি বলেন, এসব সেন্টারে মায়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়ার অনেক নাগরিক তিনি দেখেছেন। দীর্ঘ প্রায় এক বছরের মধ্যে বাড়িতে যোগাযোগ করার সুযোগ পাননি তেমন। গত অক্টোবর মাসে প্রশাসনে পরিবর্তন আসে এবং এই সময়ই সেন্টারের এক পুলিশের সাহায্যেই মুক্তি পেতে সক্ষম হন শাজাহান। সেই পুলিশের মাধ্যমে বাড়ি থেকে টাকা আনতে হয় তাকে এবং বাকি ব্যবস্থা করা হয়। তিনি জানান, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১১ হাজার রিঙ্গিত এনে তাকে দিতে হয়েছে। ডিটেনশন সেন্টারে এমন অনেকে রয়েছেন যারা প্রায় তিন থেকে চার বছর ধরে আটক রয়েছেন।
শাজাহান এখন অপেক্ষা করছেন টাকার, যা দিয়ে টিকেট কেটে বাড়ি ফিরবেন। হাতে পাসপোর্ট নেই তার। এখনো পুলিশ এড়িয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
সাজাহানের মত আরো অনেকে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে এখনো সপ্নের মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকার এখন অবৈধ প্রভিবাসী প্রবেশ রোধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। শক্ত করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
তাই নৌকায় করে মালয়েশিয়া পাড়ি দেওয়া অনেকটা আত্মহত্যার মতোই ব্যাপার।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৪