কুয়ালালামপুর থেকে ফিরে: প্রবাসে দেশের মানুষের অভিভাবক বলা হয়ে থাকে সে দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনারকে। তাই প্রবাসীদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকে দূতাবাস পরিবারের কাছে।
সব প্রত্যাশা পূরণ হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস যেনো সব প্রত্যাশার প্রতিই সমানভাবে উদাসীন। প্রয়োজন মেটানোর মতো চাহিদা পূরণের বিষয়ে আলসেমি আর অমনোযোগিতার অভিযোগ আছে বাংলাদেশ দূতাবাসের বিরুদ্ধে। এছাড়া ঘুষের অভিযোগেও জর্জরিত কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ প্রশাসন।
২০০৯ সালের জুন থেকে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এ কে এম আতিকুর রহমান। হাইকমিশন সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২২ ডিসেম্বর থেকে তিনি আর থাকছেন না এম্বেসিতে। তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন সৌদি আরবে নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. শহীদুল ইসলাম।
মালয়েশিয়ায় ঠিক কতো বাংলাদেশি রয়েছে তার কোন নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানও নেই দূতাবাসের কাছে। তবে অনুমান করা যায়- বৈধ, অবৈধ মিলে এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়াবে। শ্রমিকদের পাশাপাশি বর্তমানে মালয়েশিয়ায় সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুতে শিক্ষক, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক, আইটি কোম্পানিগুলোতে কম্পিউটার প্রকৌশলীও রয়েছে অনেক। আর সব শ্রেণী-পেশার মানুষেরই অভিযোগ রয়েছে দূতাবাসের বিরুদ্ধে।
মালয়েশিয়ায় প্রবাসীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কেমন হাইকমিশন প্রত্যাশা করেন আপনারা? জবাবে তারা বাংলানিউজকে বলেন, প্রবাসে হাইকমিশনার আমাদের অভিভাবক। বিপদে-আপদে সবাই তার ওপরই ভরসা করবে। কিন্তু মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন বিমাতাসুলভ আচরণ করে।
মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বড় শ্রেণীটি শ্রমিকের। তাই সবারই চাওয়া হাইকমিশনার এবং তার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হবেন শ্রমিকবান্ধব। বলা বাহুল্য, যে সেখানে কর্মরত- বাংলাদেশি শ্রমিকদের সিংহভাগের শিক্ষা খুবই স্বল্প। অনলাইন থেকে শুরু করে কাগজ-কলমের প্রক্রিয়াগুলোতেও ভয় কাজ করে তাদের।
প্রবাসে শ্রমিকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পাসপোর্ট ও ভিসা। বিশেষ করে পাসপোর্ট নবায়ন করতে হাইকমিশনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল তারা। আর হাইকমিশনের পাসপোর্ট বিভাগের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি অভিযোগ প্রবাসীদের।
দেশের মানুষের পকেট থেকে বাড়তি রিঙ্গিত বের না হলে, এখানে ফিঙ্গার প্রিন্ট থেকে শুরু করে ছবি তোলার প্রক্রিয়া এবং পাসপোর্ট ডেলিভারি সবকিছুতেই দেরি হয়। এমনকি ভিসার মেয়াদের পরেও পাসপোর্টের ফিঙ্গার প্রিন্টের তারিখ দেয়া হয়, ৫ বা ৬ মাস পরে।
মালয়েশিয়ায় দূতাবাসের কর্মকর্তা ছাড়া এমন একজন প্রবাসী খুঁজে পাওয়া কঠিন, যার অভিযোগ নেই দূতাবাসের বিরুদ্ধে।
প্রবাসীদের প্রত্যাশা-নতুন নিযুক্ত হাইকমিশনার হবেন বন্ধুসুলভ। প্রবাসীদের সঙ্গে মিশবেন, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নেবেন, নিজেদের সংস্কৃতি বিকাশে উদ্যোগ নেবেন।
শ্রমিকরা যেন হাইকমিশনে গিয়ে সহজে সেবা পায়, মাসের পর মাস পাসপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করতে না হয়, সে বিষয়ে যত্ন নিতে হবে। কারণ শ্রমিকরা মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে যান এম্বেসিতে। সেদিনের ওভারটাইমের বেতন মার যায় তাদের।
স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকদের জন্যে সেবার মান বাড়াতে হবে কর্মচারীদের। ধমক না দিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে তাদের। তারা যেন এম্বেসিকে ভয় না পেয়ে বরং সেখানে সেবা নিতে পছন্দ করেন।
মালয়েশিয়ায় নেই বাংলাদেশিদের একটি একতাবদ্ধ কমিউনিটি। কারণ শক্তিশালী সংস্কৃতির বিকাশ সেখানে হয়নি। প্রবাসীদের বিশ্বাস, নতুন হাইকমিশনার বিষয়টিতে দৃষ্টি রাখবেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যে যেমন বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত স্কুল গড়ে উঠেছে, মালয়েশিয়ায় তেমনটি হয়নি। সেখানে প্রবাসীদের সন্তানদের মালয় স্কুলেই পড়াশোনা করতে হচ্ছে। বাংলা ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশের সন্তানরা।
কোম্পানির দুর্নীতির কারণে বা মালিকের অনিয়মের কারণে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয় প্রবাসীদের। শ্রমিকরা অসহায় হয়ে পড়ে অনেক সময়। পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়। এমন বিপদে হাইকমিশনকেই তো বাড়াতে হবে সাহায্যের হাত। যেমনটি নেপাল, থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়ান এম্বেসি তাদের শ্রমিকদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জেলখানায় সবসময়ই আটক থাকে বিভিন্ন বাংলাদেশি শ্রমিক। অবৈধ কাজে জড়িত থাকা ছাড়াও অনেকে পুলিশি হয়রানিতে আটক থাকে। এসব বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে যুক্তিসঙ্গত আলোচনার মাধ্যমে সুরাহায় মনোযোগ দিতে হবে এম্বেসিকে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪