কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া থেকে: ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে পরিচিত জনকে এক মিনিট ফোন দেওয়ার জন্যে খরচ করতে হয় ২০০ রিঙ্গিত। আর এটিই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল ফোন কল।
এমন কথা জানালেন মালয়েশিয়ার ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশিরা।
২০১৪ সালের শেষ দিকে কুয়ালালামপুরে আসেন চট্টগ্রামের ছেলে মো. রহিম। স্টুডেন্ট ভিসায় কুয়ালালামপুরের টিএমসি কলেজে ভর্তির জন্য যান তিনি। ভিসা ইস্যুর জন্য কলেজে পাসপোর্ট জমা দেন। কলেজ থেকে ভর্তির প্রমাণসহ স্লিপও দেওয়া হয়।
মালয়েশিয়ায় এসে সাইবার জায়ায় চট্টগ্রামের এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন সেদিন তিনি। আর সে রাতেই সেখানে অভিযান চালায় ইমিগ্রেশন পুলিশ। কলেজের স্লিপ দেখালেও তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়।
এক সপ্তাহ আটকে রাখা হয় থানায়, দালাল মিজানকে ফোন করা হলেও তাতে সাড়া দেননি তিনি। আর বরাবরের মতোই আটক শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি টিএমসি কলেজ।
বাংলানিউজকে রহিম বলেন,‘কয়দিন থানায় আটকে রাখার পর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে। ’
আলাপচারিতায় বিদেশ বিভূঁইয়ের ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকার সময় কষ্টদায়ক নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি।
রহিম বলেন,‘প্রথমে আমি বিষয়টি মিজান ভাইকে জানাই। পরে ফোন দিলেও তিনি আর ধরতেন না। এরপর বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফোন দিই। কিন্তু তাদের ফোনও ধরেন না মিজান। এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষও ক্যাম্পে যোগাযোগ করেনা। ’
‘এ সময় মালয়েশিয়ায় প্রতিটি ফোনের জন্যে ২০ রিঙ্গিত খরচ করতে হয় বন্দিদের। আর বাংলাদেশে প্রতিমিনিট ফোন কলের জন্যে ৫০ রিঙ্গিত করে নেওয়া হতো,’ বলেন তিনি।
দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোন নিয়েই এসব কল দেওয়া হতো বলে জানালেন রহিম।
বললেন, ‘প্রথমবার ফোন দেওয়ার জন্যে টাকা নেওয়া হয় না। তবে বাড়ি থেকে বা পরিচিতজন থেকে টাকা পাঠালে সেখান থেকে কেটে নিতেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ’
‘নোংরা এবং নিম্নমানের খাবার দেওয়ার পাশাপাশি কারণে অকারণে শারীরিক নির্যাতনও ছিলোই। ’
ক্ষোভ নিয়ে রহিম বলেন,‘কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জবাব আসতে প্রায় সাড়ে ৪ মাস লেগে যায়। তবে মে মাসে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার আগে শেষবার ফোনের জন্য ২০০ রিঙ্গিত (তৎকালীন সময়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা) নেওয়া হয়।
‘এটাই ডিটেনশন ক্যাম্পের অলিখিত ফোন কল রেট। শেষ ফোন কলটি ছিল মালয়েশিয়াতেই। যে যেখানেই ফোন দিক, শেষ কলের জন্যে ২০০ রিঙ্গিত নেওয়া হয়,’ যোগ করেন তিনি।
রহিম বলেন, আমাদের কয়েকজনকে একসঙ্গে আদালতে হাজির করা হতো এবং সেখান থেকে ক্যাম্পে নেওয়া হতো। আইনি লড়াইয়ের জন্য আমাদের পক্ষে কোনো আইনজীবীই ছিলেন না।
তিনি জানান, বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ডিটেনশন ক্যাম্পে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের লোকও ছিলেন। তাদের দূতাবাস থেকে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হতো। তারা বৈধ হলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এখান থেকে বের করা হতো। আবার অবৈধদেরও দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিত দূতাবাস।
তিনি বলেন, ক্যাম্পে আমরা প্রায় দুই শতাধিক বাংলাদেশি ছিলাম। এরমধ্যে যাদের বাড়ি থেকে দ্রুত টাকা পাঠানো হতো এবং মালয়েশিয়ায় পরিচিত লোকজন থাকে, তারা দ্রুত বের হয়ে যান।
‘সাড়ে ৪ মাসে আমরা একবার মাত্র শুনেছি, বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একজন কর্মকর্তা ক্যাম্পে এসেছেন। তবে তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি,’ বলেন রহিম।
বললেন,‘এসব ডিটেনশন ক্যাম্পে অনাহারে, অবহেলায় পড়ে আছেন বাংলাদেশিরা। ’
এদিকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে থাকা বাংলাদেশিদের মুক্ত করতে ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সৈয়দ মিনহাজুর রহমান।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, শুধুমাত্র তথ্য এবং সঠিক পদক্ষেপের অভাবে অনেক বাংলাদেশি পড়ে আছেন ডিটেনশন ক্যাম্পে। একটু সঠিক সহযোগিতাই তাদের মুক্ত করতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৫
এমএন/এমএ