ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

মালয় মুলুকে ফিরিঙ্গির বসতি

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৬
মালয় মুলুকে ফিরিঙ্গির বসতি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মালাক্কা থেকে: এক তরুণী আর এক মধ্যবয়সী পর্তুগিজ গিটার বাজিয়ে গান করছে। পর্তুগিজ ভাষার সেই গানে আলফানসো ডি আলবাকুয়েরক এর স্তুতি কতোটা আছে বলা মুশকিল, তবে ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে থাকা ওই অসম সাহসী সেনাপতির স্মৃতি নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে দুর্গের এই অংশটা।

পলেস্তারা খসা দেওয়াল থেকে দাঁত বের করে যেনো ৫শ’ বছরের গল্প বলছে পুরনো ইটের দল।

দু’পাশে দু’টো কামান যেনো পর্তুগিজদের মালাক্কা জয়ের গৌরবময় সাক্ষী। এসব কামান থেকেই কি ৫শ’ বছর আগে স্থানীয় তামিল আর গুজরাটি মুসলিমদের ওপর গোলা ছুঁড়েছিলো আলবাকুয়েরকের সেনাদল? মরিচা পড়া এই কামান আর দুই পর্তুগিজের গলা ছাড়া গান কি তবে তোপের মুখে মালয় উপদ্বীপ জয়ে গণহত্যা আর গৌরবগাথার অবিস্মরণীয় কাহিনী?

তাহলে একটু বরং ঘুরে আসা যাক ৫ শতাব্দী আগের সেই সময়টা থেকে। ১৪ শতকের শেষ নাগাদ ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার হয়ে গেছে। দক্ষিণ-পূর্ব্ এশিয়ায় মসলা বাণিজ্য জমজমাট। আরবের সঙ্গে মসলা বাণিজ্যের রুটে ভিয়েতনামিজদের একচেটিয়া আধিপত্য। আর প্রধান বাণিজ্য পথ মালাক্কা প্রণালীতে টোল তুলছেন সুলতান মাহমুদ শাহ। সেদিকে নজর পড়লো অতৃপ্ত ইউরোপের। ১৫ শতকের গোড়াতেই হয়ে উঠলো বেপরোয়া মসলালোভী।     

পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন ভিয়েতনামিজদের আধিপত্য ভেঙ্গে সরাসরি উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে মসলা সংগ্রহে উদ্যোগী হলেন। ১৪৯৮ সালে ভারতের পূর্ব উপকূলে এসে পৌছুলেন ভাস্কো দা গামা। কালিকুটে ঘাঁড়ি গাড়লো পর্তুগিজ বাহিনী। বানালো দুর্গ।  

১৫০৯ সালের ১ আগস্ট পর্তুগালের রাজার পত্র নিয়ে দূত হিসেবে মালাক্কায় এলেন দিয়াগো লোপেস ডি সেকুরিরা। কিন্তু তৎকালীন তামিল ও গুজরাটি মুসলিমরা বহি:শক্তি ধরে নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসলো। ডি সাটুরিয়া প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। নোঙর করা কিছু জাহাজসহ বন্দি হলো তার কিছু সৈন্য।

পর্তুগিজদের নতুন ভাইসরয় হয়ে এলেন আলফনসো ডি আলবাকুয়েরক। ১৫১০ সালে গোয়া দখল করে  সেখানে পর্তুগিজদের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর ও নৌ ঘাঁটি স্থাপন কলেন তিনি। তারপর মনোযোগী হলেন মালাক্কা জয়ে।
 
১৫১১ সালের এপ্রিল মাসে ১৪শ’ সৈন্য নিয়ে মালাক্কা প্রণালীতে এসে নোঙর ফেললো তার ১৮টি জাহাজের বহর।  

প্রথমেই তিনি বন্দিদের ফেরত চাইলেন। একই সঙ্গে অনুমতি চাইলেন দুর্গ গড়ার। কিন্তু সেই প্রার্থনায় কান দিলেন না মালাক্কার সুলতান।

একদিন, দু’তিন করে তিন মাস অতিবাহিত হলো। জুলাইয়ের ২৫ তারিখে আক্রমণ করে বসলো পর্তুগিজ বাহিনী। তোপ দাগতে থাকলো সুলতানের প্রাসাদ ও আশপাশে জনবসতিতে।

প্রশিক্ষিত সেনা দল আর গোলা-বারুদের বিরুদ্ধে পেরে উঠলেন না মালাক্কার সুলতান। পর্তুগিজ বাহিনী মালাক্কা দখল করে নিলো  আগস্টের ২৪ তারিখে। সুলতানের প্রাসাদসহ গোটা শহরই দখল করে নিলেন আলবুকুয়েরক। রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেলেন মালাক্কার সুলতান।

পরবর্তী ১৩০ বছর মালাক্কা  রইলো পর্তুগিজদের দখলে।  যে পাহাড়ের পাদদেশে সুলতানের আস্তানা ছিলো, মালাক্কা জয়ের মাত্র এক বছরের মধ্যে সেখানে পাথরের দুর্গ নির্মাণ করলো (১৫১২) পর্তুগিজরা। নাম দিলো ফ্যামোসা।  মালয় কবর, মসজিদ ও অন্যান্য ভবন থেকে পাথর খুলে এনে গাঁথা হলো দুর্গের দেওয়াল।  

হিন্দু, চাইনিজ ও বার্মিজদের ছেড়ে দিলেও মুসলিমদের হত্যা করলো আলবাকুয়েরক এর সেনা দল। যাদের বাঁচিয়ে রাখা হলো তাদের বিক্রি করে দেওয়া হলো দাস হিসেবে।

যেখানে দুর্গ গড়া হলো সেই পাহাড়েরই মাথায় ১৫২১ গালে নির্মিত হলো সেন্ট পল চার্চ। ওই চার্চের দিকে উঠে যাওয়া বাঁধানো সিঁড়িটা এখনো আছে। সংস্কারের আড়ালে প্রধান সিঁড়িটার প্রাচীনত্ব হারিয়ে গেলেও পাহাড়ের চূড়ায় বিভিন্ন দিক থেকে ওঠার ছোট ছোট সিঁড়িগুলোতে এখনো ৫ শতাব্দীর ভাঙ্গা পাথর।  

পুরো পাহাড় নানা গুল্মলতা আর ঘাসে ছাওয়া। নানা রঙা ফুল ফুটে আছে পাহাড়ের গায়ে। আজদাহা শরীর নিয়ে পথের ওপরে ঝুঁকে পড়া মহীরুহটার বয়স কতো বুঝা মুশকিল। কিন্ত সেটা সে অনেক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।  

পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই বুঝা গেলো, কেনো ওই চার্চকে ১৫৬৭ সাল নাগাদ দুর্গে পরিণত করেছিলো পর্তুগিজরা। শত শত বছর ধরে তীর ভূমিতে গড়ে ওঠা জনবসতি জলরেখাকে বেশ কিছুটা সরিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু এখনো খালি চোখেই নজরে আসছে মালাক্কা প্রণালী। পূর্ব থেকে এসে পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে এগিয়ে পশ্চিমে প্রণালীতে মিশেছে মালাক্কা নদী।  

পাহাড়ের কোলে চারিদিকে তৈরি হয়ে আছে ছোট ছোট প্রাকৃতিক খোপ। পর্যবেক্ষণ চৌকি বা নিরাপত্তা পোত হিসেবে ওগুলোর তুলনা কেবল ওগুলোই। গির্জার সামনে উঁচু টাওয়ারটায় বসে নিশ্চয়ই মালাক্কা প্রণালীর নৌযান চলাচলে নজর রাখা হতো! অনেক আগেই ধসে পড়ে গির্জাদুর্গের ছাদ এখন খোলা আকাশ।  

শত শত বছরের নিরক্ষীয় রোদ-বৃষ্টির সঙ্গে লড়ে টিকে আছে কেবল বিবর্ণ দেওয়ালগুলো। সেগুলোতে হেলান দিয়ে রাখা ১৬ শতকের বেশ ক’টি এপিটাফ। মালাক্কা জয়ের কয়েক বছরে মধ্যে যেসব পর্তুগিজের মৃত্যু রয়েছে তাদের এপিটাফও চোখে পড়লো কয়েকটি।  

ঘরের একপাশে সিঁড়ি নেমে গেছে পাহাড়ের পেটে। পরিত্যক্ত বলে খাঁচা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে সুড়ঙ্গটা। তারই একপাশে বসে নিমগ্ন চিত্তে ছবি আঁকছে কয়েকজন পর্তুগিজ। এদেশে তাদের সব কিছু তো এই পাহাড়কে ঘিরেই হয়।  

সাধু পলের নামানুসারে এই পাহাড়ের নাম তো সেন্ট পল পাহাড়ই রাখে পর্তুগিজরা।  ভারতের গোয়ায় নেওয়ার আগে ১৫৩৩ সালের ২২ মার্চ থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেন্ট জেভিয়ার্সের মরদেহ রাখা হয় এখানকারই সমাধিতে।  

অনেক আক্রমণ ঠেকিয়ে ১৩০ বছর এই পাহাড়েই থাকে পর্তুগিজরা। তারপর পরাজিত হয় ডাচ আর মালাক্কার সম্মিলিত বাহিনীর কাছে।  

১৬৪১ সালে ডাচ ও জোহর সাম্রাজ্যের সম্মিলিত আক্রমণে পর্তুগিজদের পতন ঘটে।  পাহাড়ের পূর্ব দিকের ঘাড়ে এখনো ইতিহাসের সাক্ষী ডাচ কবরস্থান। ১৭ শতকের বেশ ক’টি পাথুরে এপিটাফ এখনো ইতিহাস বইছে শরীরে। গোটা কবরস্থানের ওপর বড় বড় লতা ছাওয়া বয়সী গাছ।  

কার্যত মালাক্কার তৎকালীন সুলতান মাহমুদ শাহ রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিঙ্গাপুর প্রণালী পাড়ের রাজ্য জোহরে। তিনি কয়েক দফা মালাক্কা উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে পালিয়ে যান পাহাংয়ে। আরো পরে বিনতান এ গিয়ে নতুন করে নিজের রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন তিনি।  

কিন্তু ১৫২৬ সালে পর্তুগিজরা বিনতানেরও পতন ঘটালে সুলতান পালিয়ে যান সুমাত্রার কামপারে। সেখানে ২ বছর পর মৃত্যু হয় তার। তার দুই পুত্র মুজাফফর শাহ ও দ্বিতীয় আলাউদ্দিন রিয়াত শাহ গড়েন পৃথক দু’টি নতুন রাজ্য।  

মুজাফফর শাহকে উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের মানুষ তাদের  শাসক হওয়ার আবহান জানায়। প্রতিষ্ঠিত হয় পেরাক সালতানাত। মাহমুদ শাহ এর অপর পুত্র, পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন জোহরে।  

কিন্তু সেই ডাচরা  ১৮২৪ সালে এক চুক্তির আওতায় মালাক্কাকে তুলে দেয় ব্রিটশদের হাতে। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা মালাক্কা শাসন করে।  মাঠে নামে ভারত উপমহাদেশে কুখ্যাতি কুড়ানো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সিঙ্গাপুর ও পেনাং এর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রণালী বসতি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত মালাক্কা থাকে জার্মান সাম্রোজ্যের অধীনে।

১৯৪৬ সালে মালাক্কা হয় মালয়ান ইউনিয়নের অংশ। ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল মালাক্কাকে ঐতিহাসিক শহর ঘোষণা করা হয়। ২০০৮ সালের ৭ জুলাই ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পায় মালাক্কা। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবার পায় উন্নত রাজ্যের মর্যাদা।

বাংলাদেশ সময়: ০১২৪ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৬
জেডেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ