কোটা কিনাবালু (বোর্নিও) থেকে: কাঠের পাটাতনে সাজানো সিঁড়িটা কিছুদূর উঠে বাঁক নিয়েছে বাঁয়ে। তারপর নিচে নেমে গেছে ফুট বিশেক।
কাঠের এই সিঁড়ি বসানো হয়েছে পাহাড়ের কয়েক ফুট ওপরে। নিচে অক্ষত লতা-পাতা আর পাহাড়ের শরীর। ইকো ট্যুরিজমে এই প্রদেশ কেনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাইওনিয়ার তা বুঝতে আর অসুবিধা হয় না।
পুরো পথটাতেই দু’দিক থেকে ঝুঁকে এসে মাথার ওপরে ছাদ গড়ে দিয়েছে লম্বা লম্বা গাছ। এ যেনো গাছের টানেল বেয়ে পাহাড় বাওয়া। বোঝা যায়, দিনের বেলাতেও সূর্যের প্রবেশাধিকার নেই এখানে। আর এখন তো সন্ধ্যা রাত। নিয়ন আলোয় চকচক করছে কাঠের সিঁড়ি। গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার কোমল শব্দ শোনা গেলেও এখনো নিচে পড়তে শুরু করেনি পাতা আর কাণ্ড বেয়ে।
এখানে ওখানে বিভিন্ন গাছ থেকে লম্বা লম্বা লতা ঝুলে আছে পথের দু’ধারে। এখানকার বাঁশগুলোও যেনো অন্যরকম। পাতা কম। শরীর বেশ মোটা। ভেতরে কতোটা ফাঁপা কে জানে!কাঠের সিঁড়িতে হড়কাতে পারে পা। থাকতে পারে সাপ-বিছা আর অন্য কোনো পতঙ্গও। তাই একটু পর পর ‘লুক অ্যাট ইয়োর স্টেপ’ লেখা সতর্কবাণী ঝুলছে।
খুব যে উপরে ওঠা তা নয়, কিন্তু তারই মাঝে কাঠের খুঁটির ওপর পাতায় ছাওয়া বিশ্রামাগার। বসার ব্যবস্থাও কাঠের গুঁড়িতে। বাংলাদেশের পর্য টন স্পটগুলোর মতো এখানে যত্রতত্র ময়লা ফেলা নেই। পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট, কোমল পানীয়ের ক্যানে বোঝাই সিঁড়ির পাশে রাখা ডাস্টবিন।
হাঁপাতে-হাঁপাতে উপরে উঠতেই হাতের বাঁয়ে কাঠের ফুটপাত। মাথায় পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে অবজারভেশন টাওয়ার।
পুরো পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে ৩৬০ ডিগ্রি অবজারভেশন টাওয়ার গড়া হয়েছে এখানটায়। মাঝখানে মাথা আরো উঁচু করে আকাশ ছুঁতে চাইছে সুঁচালো চূড়া। তার মাথায় এক বাংলো বাড়ি। পাহাড় ঘিরে গড়া অবজারভেশন পোস্টে একটু পর পর বসার ব্যবস্থা। সুঁচালো চূড়া আর অবজারভেশন পথের মাঝখানে পাকা রাস্তা। সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটছে ওখানটা দিয়ে। এই অবজারভেশন ডেকের একেক স্থানে বসলে একেক রূপে ধরা দেবে প্রকৃতি।
একখানে বসলে দেখা যাবে শহর, আর একখানে দক্ষিণ চীন সাগরের সুনীল জলরাশি। ছোট ছোট দ্বীপগুলোকে ছবির মতো মনে হয় এখান থেকে। সূর্যাস্ত দেখার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা বুঝি আর হয়ই না। আর একখানে বসলে চোখের সামনে ঝুলে আসবে সবুজ পাহাড় সারি।
মাত্র শ’পাঁচেক ফুট উঁচু অবজারভেশন ডেকটা। তবু এটা কোটা কিনাবালু শহরের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট। এ রাজধানীতে এতো উঁচু কোনো বহুতল ভবন নেই। অবজারভেশন টাওয়ারের সিটি ভিউ পয়েন্টে দাঁড়ালে তাই গোটা শহরটাই ধরা পড়ে খালি চোখে। পোস্টের পেছনে ফুড কর্নার। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গলাকাটা দাম চোখে পড়লো না। চাইলে মাত্র ১০ রিঙ্গিতে (১ রিঙ্গিতে ১৯ টাকা) ডিনার সারার সুযোগ আছে এখানে।
চোখের সামনে ফুটে থাকা শহরটা আলো ঝলমলে। শপিং মল আর হোটেল রেস্তোরাঁর চোখ ধাঁধানো আলোতে সয়লাব পুরো শহর। কোনো আলো লাল, কোনোটা হলুদ, কোনোটাবা ছড়াচ্ছে নীল, সবুজ মায়াবী দ্যুতি। শহরের আকাশে ওসব আলোরই প্রতিফলন অন্যরকম এক আবহ তৈরি করেছে। মনে হলো, সন্ধ্যার আকাশে হাজার হাজার রঙধনু হাসছে। এতোক্ষণ ধরে টিপ টিপ ঝরতে থাকা বৃষ্টি ঝেঁপে নামলো এবার। শহরজুড়ে তৈরি হলো আরো বেশি আলোর মায়া। এটা যে বৃষ্টি প্রধান এক ঋতুরই দেশ তা মনে পড়লো এবার। বছরে ৫০০ সেন্টিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয় এখানে। আর এই নভেম্বরে আরো বেড়ে যায় বৃষ্টির দাপট। এখন শুরু হওয়া বৃষ্টির দাপট কখন কমবে কে জানে!
পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা গাছগুলোতে অনবরত পড়া বৃষ্টির ফোটা অন্যরকম এক সুরের সিস্ফনি তৈরি করেছে যেনো। তবে মেঘের গুরুগুরু ডাক কানে এলো না। এলো না বিদ্যুতের ঝলকানি বা মেঘের সঙ্গে মেঘ বাড়ি খাওয়া বজ্রপাতের শব্দও। এই বৃষ্টির মধ্যেও প্লেন ওঠানামা করছে কোটা কিনাবালু এয়ারপোর্টে। এখানকার বৃষ্টিটা ঠিক বাংলাদেশের মতো নয়তো!
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১৬
এইচএ/জেডএম/
আরও পড়ুন
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে