সান্দাকান (বোর্নিও) থেকে: শতবর্ষী মসজিদ জামেক থেকে শুরু হলো ঐতিহাসিক অতীতের পথে হাঁটা। মসজিদটা টিলার উপরে।
নির্দেশনা মেনে সামনে পা বাড়াতেই সিটি কাউন্সিলের সামনে গ্রানাইট পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ। সান্দাকানের প্রতিষ্ঠাতা ইউলিয়াম বি প্রায়োরের নামাঙ্কিত পাতটা ক্ষয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। ওপাশে পাহাড়ের উপরে উঠে গেছে বাঁধানো সিঁড়ি। বাঁশবনের ভেতর দিয়ে গড়া সিঁড়িটায় টিনের ছাদ। জায়গাটা নির্জন বলে কয়েক জোড়া টিনএজার প্রেমে মত্ত সেখানে। ভিনদেশি এই আগন্তুকের দিকে খেয়ালই নেই তাদের।
শ’দুই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বাঁয়ে মোড় নিতেই শহর প্রশাসকের বাসভবন। বিপরীতে অর্ধবৃত্তাকার ফ্লাটফর্মটা ঝুলে আছে পাহাড়ের গায়ে। এবার পায়ের নিচে সান্দাকান শহর। চোখের সামনে সুলু সাগরের উন্মুক্ত পোতাশ্রয়।
সাগরটাকে এখানে বৃত্তের মতো বেড় দিয়ে রেখেছে মিন্দানাওয়ের বর্ধিত অংশ সুলু দ্বীপপুঞ্জ। আর প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ এই সুলু সাগরের এখানটায় সৈকত ছুয়ে অর্ধবৃত্তাকারে গড়ে উঠেছে সান্দাকান শহর। উন্মুক্ত জলরাশির দৃষ্টিসীমায় ওই বড় দ্বীপটার নাম টার্টেল আউল্যান্ড। নানা প্রজাতির কচ্ছপ ওখানে এসে ডিম দেয়। কিন্তু সারি সারি দ্বীপ আর আশপাশের জলরাশিতে কারফিউ চলে সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর ৫টা অবধি। দক্ষিণ ফিলিপাইনের জঙ্গি ঠেকাতেই এ আয়োজন সাবাহ সরকারের।
প্লাটফর্মের উল্টোদিকে আর একটা উঁচু টিলার উপরে বিখ্যাত মার্কিন লেখিকা অ্যাঙস কেইথ এর হাউস। বিশাল বিশাল গাছঘেরা বাড়িটা এখন সান্দাকান মিউজিয়াম।
পাহাড় বেয়ে আর একটু নামতেই ক্লক টাওয়ারের উল্টোদিকে অনেকগুলো পাথর। ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকা এসব পাথর আসলে আর এক ঐতিহাসিক ভবনের ধ্বংসবাশেষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই সান্দাকানই তো ছিলো ব্রিটিশ চার্টারড নর্থ বোর্নিও কোম্পানির রাজধানী। জাপানিরা সে শহর গুঁড়িয়ে হত্যা করেছিলো ২ হাজার ৪০০ অস্ট্রেলীয় ও ব্রিটিশ বন্দিকে। শহরের বাইরে সারি সারি কবর এখনো সেই বিভীষিকার সাক্ষী।
ধ্বংসাবশেষ পেরিয়ে বিশাল এক গাছের গোড়ায় ছোট্ট এক চাইনিজ খুপরি। ওটাকে দেবীর দয়া বলে থাকে চাইনিজরা। একটু দূরে আরো একটা মন্দির আছে তাদের। তারপর একটা চার্চ।
শহরের একমাত্র স্টেডিয়ামে মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ চলছে। পুরনো অংশটায় মোটর গ্যারেজের মতো শার্টারের ভেতরে বোর্নিও পোস্টের আঞ্চলিক অফিস। আর একটু এগুতেই সারি সারি তাঁবুতে রাতের বাজার বসেছে। মূলত নারীরাই দোকানি এখানে। পেছনে সৈকত ছুঁয়ে গড়া রানওয়ের মতো রাস্তাটায় ইয়ংস্টারদের মোটরবাইক মহড়া চলছে।
ফিলিপাইন সাগরের টাইফুন প্রায়ই আঘাত হানে এদিকটায়। জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে শহর রক্ষায় তাই সাগর তীরে বুক সমান উঁচু কংক্রিটের দেওয়াল। ওপাশে পাথর ফেলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে সাগর তীর। এখানে তাই সমুদ্র সৈকত বলে কিছু নেই। কেউ এখানে সমুদ্র স্নানেও নামে না। বিশাল বিশাল বোল্ডারগুলোর ওপরে বসে ছিপ ফেলেছে সারি সারি মাছ শিকারী।
সুলু সাগরের ওপরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চোখের সামনে অন্ধকারে হারিয়ে গেলো টার্টেল আইল্যান্ড। কারফিউ বলে ওদিকটায় কোনো আলোও নেই। আজ রাতে আর এই সাগরে টহল বোট ছাড়া অন্য কোনো নৌয়ান ভাসবে না।
বন্দর হারবারে বিশাল এক জাহাজ নোঙর ফেলা। তীর থেকে লাফ দিলেই চড়া যাবে তাতে। তার মানে এখানে তীরের কাছেই গভীর পানি। সেই পানি ছুঁয়ে বসেছে সীফুড রেস্টুরেন্ট। ওপাশের শপিংমলটাই সম্ভবত সান্দাকানের সবচেয়ে বড় ভবন। সারি সারি রেস্টুরেন্টগুলোতে ফিলিপিনো মেয়েদের মেলা বুঝিয়ে দিলো, কেনো মিনি ফিলিপাইন বলা হয় সান্দাকানকে।
হারবার জেটির কাছে ফিলিপের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ফের। কুয়ালালামপুর থেকে কোটাকিনাবালুতে মালয়েশিয়ার এয়ারলাইনসের একই ফ্লাইটে এসেছি আমরা। আমার মতো সুইজারল্যান্ডের এই যুবকও ছিলো কোটা কিনাবালুর একটা কম খরচের হোটেলে। কাকতালীয়ভাবে সান্দাকান যাওয়ার সময়ে এ্কই বাসে ফের সঙ্গী দু’জন। পরদিন সেপিলক রিভার্ভ ফরেস্টে যাওয়ার সময়েও কেবল আমরাই দু’জন ছিলাম বাস যাত্রী। ফিরে আসার পথে জানা গেলো, সান্দাকানেও একই হোটেলে আছি আমরা।
একটা সুপারমলের সেলসম্যান হিসেব নিজের পরিচয় দিয়েছে ফিলিপ। ঘোরাঘুরি আর ছবি তোলাটাকে নিজেই বলেছে, ব্যয়বহুল শখ। তবে কাল থেকে দু’জনের পথ হয়ে যাচ্ছে আলাদা। মিরি হয়ে থাইল্যান্ড যাবে ফিলিপ। এ ক’দিনে তো বন্ধুই হয়ে গেছিলাম আমরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৬
জেডএম/
** সূর্য ভাল্লুকের সঙ্গে লুকোচুরি
** ওরাংওটাং এর সঙ্গে দোস্তি
** অচেনা শহরের আলোকিত মানুষ
** সাড়ে ৫ হাজার ফুট উঁচু রাস্তা পেরিয়ে
**সাত ঘণ্টাতেই শেষ রাজধানী চক্কর
** সিগনাল হিলে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি
** চীন সাগরে মেঘ-সুরুযের যুদ্ধ
** মালয় তরুণীর বিষাদমাখা রাতে
** জিভে জল আনা বাহারি সি-ফুড
** চীন সাগর পেরিয়ে ওরাংওটাংদের দেশে